অভাব ঘোচাতে ঢাকা গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন বিপ্লব

বাসস
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৫, ১৭:৫৮ আপডেট: : ১২ মার্চ ২০২৫, ২১:১৭
শহীদ বিপ্লব শেখ। ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : আজাদ রুহুল আমিন

বাগেরহাট, ১২ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : অভাবের সংসারে একটু সচ্ছলতা আনতে গ্রাম ছেড়ে ভ্যানচালক বাবাকে নিয়ে ঢাকা গিয়ে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন বিপ্লব শেখ, কিন্তু হলো তার উল্টো। গোটা পরিবারকে অথৈ সাগরে ফেলে দিয়ে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি।

বিপ্লব শেখ (১৯) ছিলেন জেলার মোল্লাহাট উপজেলার গাংনী ইউনিয়নের বুড়িগাংনী গ্রামের ভ্যানচালক বাবা পারভেজ শেখ (৩১) ও মা এলিজা বেগম (২৮)-এর ছেলে।

বিপ্লব শেখ ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই সকালে ১০ নম্বর রোডে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিশাল মিছিলে অংশ নেন। এ সময় পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন।

রাতে বাসায় ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে বাবা পারভেজ শেখ ছেলের মোবাইলে ফোন দেন। অপর একজনের গলার স্বর ভেসে আসে। পরিচয় জানতে চাইলে বলেন, তিনি মিরপুর আজমল হাসপাতালের দারোয়ান। বিপ্লবের কথা জানতে চাইলে বলেন, ‘সে খুব অসুস্থ, আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।’

পারভেজ শেখ দ্রুত ছুটে যান। রাত তখন সাড়ে বারোটা। হাসপাতালের ফ্লোরে শোয়ানো চারটি লাশের মধ্যে তিনি ছেলের লাশ দেখতে পান।

হাসপাতাল থেকে বলা হয়, কান্নাকাটি করলে লাশ পেতে ঝামেলা হবে। মৃত্যু সনদ চাইলেও দেওয়া হয়নি। পারভেজ শেখ ছেলের লাশ নিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সযোগে ৩০ জুলাই ভোর ৫টায় গ্রামের বাড়ি পৌঁছান।

জানাজার আগে গোসল করানোর সময় বিপ্লব শেখের মাথার পেছনে ও কোমরে দুটি বুলেটের গভীর ক্ষত দেখা যায়। বাড়ির উঠানে জানাজা শেষে পারিবারিক যে সামান্য জায়গা আছে, সেখানেই দাফন করা হয় শহীদ বিপ্লবকে।

সংসারের অভাব-অনটন ঘোচানোর আশায় দুই বছর আগে পরিবার নিয়ে রাজধানী ঢাকার মিরপুর ৭ নম্বর রোডে বিটি কলেজের বিপরীতে ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন বিপ্লব শেখ। বাবা পারভেজ শেখ কাছের বাজারে ঘুরে ঘুরে ভ্যানে শাকসবজি বিক্রি করতেন।

বিপ্লব শেখ মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে একটি গার্মেন্টসে আয়রনম্যান হিসেবে চাকরি করতেন। তার বেতনের টাকাতেই মূলত সংসার চলত।

বাসস প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বিপ্লবের বাবা পারভেজ শেখ বলেন, ‘আমার বড় ছেলের ইনকামে সংসার চলত। এখন সে নেই। তাই খুবই আর্থিক কষ্টে আছি।’

বিপ্লবের দ্বিতীয় ভাই রমজান শেখ (১০) স্থানীয় মাতারচরে ক্বারিয়ানা শেষ করে হাফেজি পড়ছে। এরপর বোন চাঁদনী (৮) বুড়িগাংনী সাইক্লোন সেন্টার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। ছোট বোন সুমাইয়া (৫) এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি।

দেড় বছর আগে একই উপজেলার গাওলা ইউনিয়নের সারুলিয়া গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান শেখ (৫০) ও রশিদা বেগম (৪০)-এর মেয়ে রিক্তা (১৮)-র সঙ্গে বিয়ে হয় শহীদ বিপ্লব শেখের। শহীদ হওয়ার কিছুদিন আগে স্ত্রী রিক্তার কোলজুড়ে একটি কন্যাসন্তান আসে। মুনিয়া নামের মেয়েটির বয়স এখন মাত্র আট মাস।

বিপ্লবের মা এলিজা বেগম বলেন, ‘দেশের জন্য ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে শহীদ হয়েছে আমার ছেলে বিপ্লব। স্বপ্ন ছিল একসময় বিপ্লব পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে ছোট ভাই-বোনদের লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন করবে এবং পরিবারকে স্বাবলম্বী করে তুলবে।’

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘অনেক কষ্টে আমাদের জীবন চলে। বিপ্লবের বাবা ভ্যান চালিয়ে যা আয় করেন, তা দিয়ে সংসার চলে না। আর্থিক সহায়তা ছাড়া ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছি।’

শহীদ পরিবার হিসেবে তারা তেমন কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি উল্লেখ করে এলিজা বেগম বাসসকে বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা পেলে আমি ও আমার পরিবার অনেক উপকৃত হব। অসহায় পরিবার হিসেবে আমাদের যেন দেখার কেউ নেই!’

তিনি জানান, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বিপ্লবের স্ত্রী রিক্তাকে দুই লাখ টাকা দিয়েছে। রিক্তা তার শিশু সন্তান নিয়ে চার-পাঁচ দিন শ্বশুরবাড়িতে থাকার পর এখন বাবার বাড়িতেই থাকছেন।

শহীদ বিপ্লবের বাবা-মা এখনও কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাননি। পারভেজ শেখ জানান, খুব টানাটানির মধ্যে সংসার চলছে। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

ছেলের লাশ বাড়ি আনার পর থেকে পরিবার নিয়ে গ্রামেই বসবাস করছেন পারভেজ শেখ। ভ্যান চালিয়ে সংসার চালানো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি। তার কোনো সহায়-সম্পত্তি বা ভিটেমাটি কিছুই নেই বলেও উল্লেখ করেন।

বিপ্লবের একই বাড়ির বাসিন্দা দাদি সম্পর্কের রুনা বেগম (৪৫) বলেন, ‘এই বাড়ির সকলেই গরিব ও অসহায়। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, শহীদ বিপ্লব শেখের পরিবারের সুখ-শান্তি ও তার ভাই-বোনের লেখাপড়ার জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক অনুদান দেওয়া হোক।’

শহীদ বিপ্লবের বাবা পারভেজ শেখ ঢাকার পল্লবী থানায় ও হাসপাতালে কয়েকবার যোগাযোগ করেও মৃত্যু সনদ নিতে পারেননি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
স্লোভাকিয়ার প্রতি বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের আহ্বান
যুক্তরাষ্ট্রে ফায়ারিং স্কোয়াডে এক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
শেরপুরে বাণিজ্যিকভাবে হাইব্রীড ধান বীজ উৎপাদন শুরু
নিম্ন আদালত মনিটরিংয়ে হাইকোর্টের ১৩ বিচারপতি
জনগণ বিচার বিভাগের ওপর হারানো আস্থা ফিরে পাবে: প্রধান বিচারপতি
নদীতে ফুল উৎসর্গে মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’
ট্রাম্পকে হত্যার ষড়যন্ত্রে এক ব্যক্তি অভিযুক্ত: মার্কিন বিচার বিভাগ
ইসরাইলি হামলায় গাজায় একই পরিবারের ১০ জন নিহত
শেরপুরের ঝিনাইগাতীর মিনি চিড়িয়াখানা থেকে ১৭টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার
দিন ও রাতের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে
১০