প্রতিবেদন: আল-আমিন শাহরিয়ার
ভোলা, ১৩ মার্চ ২০২৫ (বাসস) : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চূড়ান্ত দিনে ছাত্রলীগের হামলায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো ১৯ বছর বয়সী শাকিলের স্বপ্ন। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল তার, কিন্তু রাজধানীর রাজপথে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে সে আজ পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পথে।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চরকলমি ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ চরমঙ্গল গ্রামের মৃত আবুল কালাম আজাদের ছেলে শাকিল। বাবা ছোটবেলায় মারা যাওয়ায় সংসারের অভাব-অনটন লেগেই ছিল।
স্থানীয় একটি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র শাকিল উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু সংসারের দারিদ্র্য তাকে প্রতিনিয়তই চেপে ধরছিল। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একদিন সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকায় গিয়ে চাকরি করার, পাশাপাশি চালিয়ে যাবে লেখাপড়াও।
অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে একসময় রাজধানীর পথে পা বাড়ায় শাকিল। তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল উত্তাল। স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল রাজপথে।
হামলার দিন: এক মর্মান্তিক বিভীষিকা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার বিজয়ের দিন। ঢাকার রাজপথ আনন্দ-উললাসে মুখরিত। সেদিন বিকেল পাঁচটার দিকে শাকিল এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে গণভবনের পরিস্থিতি দেখতে বের হয়। কিন্তু তখনও সে জানত না, তার জীবনের মোড় পুরোপুরি বদলে যাবে সেদিন।
গুলশান এলাকায় পৌঁছতেই ছাত্রলীগের একদল সন্ত্রাসী তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা লোহার রড ও লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকে শাকিলকে। মুহূর্তের মধ্যে লুটিয়ে পড়ে সে, আর তার ডান পা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
শুধু শারীরিক আঘাতই নয়, সেই সঙ্গে দুমড়ে-মুচড়ে যায় শাকিলের ভবিষ্যৎও। সেনাবাহিনীতে চাকরি করার স্বপ্ন নিয়ে যে তরুণ লড়াই করছিল, সে এখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সামর্থ্যও হারিয়েছে।
চিকিৎসার অভাবে অনিশ্চিত জীবন
হামলার পর শাকিলকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, তার পায়ের হাড় একাধিক জায়গায় ভেঙে গেছে। দ্রুত অস্ত্রোপচার না করলে পায়ের সংক্রমণ বাড়তে পারে এবং তা ক্যানসারে রূপ নিতে পারে।
কিন্তু চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই শাকিলের পরিবারে। ঢাকার হাসপাতালে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা নিলেও এখনো অর্থের অভাবে অস্ত্রোপচার করানো সম্ভব হয়নি।
বর্তমানে শাকিল বাংলাদেশ অর্থোপেডিক্স হাসপাতালের তিনতলার ভি ওয়ার্ডের ৩২ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাকে আরও দুই মাস হাসপাতালে থাকতে হবে। কিন্তু ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ জোগাতে পারছে না তার পরিবার।
মায়ের আর্তনাদ: ‘আমার ছেলেকে বাঁচান’
শাকিলের মা অজুফা খাতুন (৪৭) এখন পুরোপুরি অসহায়। ছেলের চিকিৎসার জন্য যা কিছু ছিল, সবই বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। এখন আর কোনো উপায় নেই তার সামনে।
‘আমার ছোট ছেলেটার জীবন হায়েনার দল তছনছ করে দিয়েছে,’ কাঁদতে কাঁদতে বলেন অজুফা খাতুন। ‘তার চিকিৎসার জন্য এখনো কাউকে পাশে পাইনি। খরচ চালাতে পারছি না। সহায়-সম্বল যা ছিল, সবই বিক্রি করে দিয়েছি। এখন আমার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য সরকারের দায়িত্বশীলদের কাছে সাহায্য চাই।’
সহায়তার অপেক্ষায়
গণঅভ্যুত্থানের এই শিকার তরুণের চিকিৎসার জন্য এখনও কোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসেনি বলে জানা যায়। ভোলার জেলা প্রশাসন থেকেও কোনো সহায়তা পায়নি বলে জানায় পরিবারটি।
স্থানীয় সচেতন মহল ও এলাকাবাসী সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তারা শাকিলের চিকিৎসার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়ান।
শেষ আশার আলো
যথাযথ চিকিৎসা পেলে শাকিল হয়তো আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে, তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ততই কমে যাচ্ছে।
অসুস্থ শাকিলের সহায়তায় সময় মতো এগিয়ে এলে হয়তো তার জীবন শুধুই একটা নির্মম বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকবে না।