প্রতিবেদন : মো. এনামুল হক এনা
পটুয়াখালী, ১৫ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : দিনটি ছিলো ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। ঠিক বিকেল ৪টা। রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় চলছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার প্রচণ্ড বিক্ষোভ। সেখানে স্বস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন পটুয়াখালীর বাউফলের কালিকাপুর গ্রামের বাসিন্দা কাওসার হোসেন।
সেদিন মৃত্যু কবুল করেই দেশের জন্য রাজপথে নেমেছিলেন তিনি। মৃত্যু হয়নি বটে, পুলিশের নির্বিচার গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। আজও শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন বুলেট আর আঘাতের অজস্র ক্ষতচিহ্ন। শুরু থেকেই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্রজনতার আন্দোলনে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন তিনি।
কাওসার হোসেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসসকে বলেন, চব্বিশের ১৯ জুলাই বিকেল ৪টায় রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় বিক্ষোভ করছিলাম। বিক্ষোভকালে আমরা কয়েকজন নয়াপল্টনে যাওয়ার উদ্দেশে মিছিল বের করি। তখন নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। একটু অগ্রসর হতেই চারপাশের সবাই লুটিয়ে পড়ে। ঘুরে তাকাতেই নাকে বারুদের ঘ্রাণ পাই।
তিনি বলেন, কিছু বোঝার আগেই গুলির আঘাতে আমার ৩টা দাঁত ভেঙে চামড়া ছিঁড়ে গুলি বেড়িয়ে যায়। মুখে হাত দিতে না দিতেই আরেকটা গুলি এসে হাতের আঙুল ভেদ করে বেরিয়ে যায়। আমি লুটিয়ে পড়ি।
তবে এরইমধ্যে মেটাল বুলেটসহ প্রায় ৩০টি গুলি বিদ্ধ হয় আমার শরীরে। এই হাসপাতাল ওই হাসপাতাল ঘুরে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয় আমাকে।
ছয়দিন ছিলাম লাইফ সাপোর্টে। তখন আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা।
কাওসারের পরিবারের সদস্যরা জানান, তখন ফ্যাসিস্ট সরকারে নির্দেশে আন্দোলন দমাতে পুলিশ হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেটা আড়ালে রাখতে সারাদেশে মোবাইল নেটওয়ার্কসহ ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়। যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে গ্রামেও। শুরু হয় গুজব প্রচার। কাওসার আর বেঁচে নেই। বলে গুজব রটে।
কাওসারের মৃত্যুর মিথ্যে খবরে পরিবারে কান্নার রোল পড়ে যায়। তাদের সন্তান কাওসার বেঁচে আছে না কি আসলেই আর দুনিয়াতে নেই- এমন চিন্তায় ভেঙে পড়েন সবাই।
কাওসার হোসেন জানান, ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত তিনি। ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহ-সভাপতি পদে আছেন। তিনি বনশ্রী ডি-ব্লকের ৪ নাম্বার রোডের মুখে ভূঁইয়া পাড়া এলাকায় একটি ভাড়া বাডায় থাকতেন তিনি।
কাওসার বলেন, রাজনীতির পাশাপাশি ছোট একটি ব্যবসা করতেন তিনি। ব্যবসার টাকায় চলত বাবা-মাকে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার। কিন্তু দীর্ঘ সাত মাস ধরে তিনি চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এতে কিছুটা অভাবে পড়েছেন।
রাষ্ট্রের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই তার। ৫ আগস্টের পর থেকে সরকার যে চিকিৎসা সেবা দিয়েছে তাতেই কাওসার সন্তুষ্ট। তবে তার উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রয়োজন।
জুলাই বিপ্লবে আহতদের তালিকায় কাওসার হোসেনের নাম সি ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কাওসারের নাম বি ক্যাটাগরিতে থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি। ১৩ মার্চ তার নাম বি ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে একটি আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন কাওসার। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
চিন্তিত চেহারায় কাওসার হোসেন বলেন, আমার সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এখনও আমার মুখমণ্ডলের ভেতরে ৭টি গুলির স্প্লিন্টার থেকে গেছে। দেশের চিকিৎসকরা বের করতে পারছেন না। দ্রুত দেশের বাইরে চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে তারা।
ভেতরে আটকে থাকা গুলির প্রভাবে যন্ত্রণায় ছটফট করে অনেক রাতই নির্ঘুম কাটে কাওসারের। এ ব্যথা সহ্য করার মতো শক্তি তার নেই। তাই তিনি সরকারের কাছে দ্রুত তার উন্নত চিকিৎসার অনুরোধ জানিয়েছেন।
কাওসার জানান, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা পেয়েছেন। এছাড়া বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রদল, উপজেলা প্রশাসন থেকেও কিছু সহায়তা দিয়েছে।
কাওসারের বাবার নাম কবির হোসেন হাওলাদার (৬৫)। বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলের সূর্যমনি গ্রামে। বাবা শয্যাশায়ী স্ট্রোকের পেশেন্ট। দুই ভাই বোনের মধ্য কাওসার বড়। ছোট বোন বিবাহিত।
কাওসারের মা কুলসুম বেগম (৫৫) বলেন, আমার ছেলে ঠিকমত রাতে ঘুমাতে পারে না। ব্যথায় কাতরায়। সে এতটাই অসুস্থ যে একটা চাকরিও ঠিকভাবে করতে পারবে না।
তিনি বলেন, যারা আমার ছেলেকে গুলি করছে তাদের ন্যায় বিচার চাই। একইসাথে আমার ছেলের ভবিষ্যতের জন্য সরকার যেন একটা ব্যবস্থা করে দেয় সেই অনুরোধ করছি।
মামলা করেছেন কি না জানতে চাইলে কাওসার বলেন, আপাতত মামলা করিনি। তবে আমাকে যারা সারাজীবনের জন্য জখম করল, আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। মামলার বিষয়ে কী করা যায় দেখব।