প্রতিবেদন: মো. এনামুল হক এনা
পটুয়াখালী, ১৬ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : কবি নজরুল কলেজের ইতিহাস বিভাগের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র মো. জিহাদ হোসেন শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আন্দোলনে গিয়ে ১৮ জুলাই কাজলায় তার হাতে ছররা গুলি লাগলেও দমে যাননি তিনি।
স্বৈরাচারী সরকারের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী আন্দোলরত ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি করছিল দেখে স্বজনরা তাকে আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করেন। তখন তিনি তাদের সাফ জানিয়ে দেন স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারবেন না তিনি। বিবেকের তাড়নায় রাজপথে আন্দোলনে নেমে শহীদ হন তিনি।
জিহাদ হোসেন পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার দশমিনা গ্রামের নুরুল আমিন মোল্লা ও শাহিনূর বেগমের সন্তান। তারা দুই ভাই, দুই বোন। পরিবারের সবার ছোট জিহাদ ছিলেন ডানপিঠে স্বভাবের। এলাকাবাসীর উপকারে ছিলেন মহানুভবতার দৃষ্টান্ত। যার প্রমাণ মিলে ২৫ বছর বয়সে ২১ বার রক্তদানের মাধ্যমে।
শুধু তাই নয়, কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে তাকে সঙ্গও দিতেন তিনি। করতেন নানাবিধ সহায়তা।
আন্দোলনে জিহাদের সক্রিয়তা
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)কে শহিদ জিহাদের বড় ভাই প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক জিন্নাত হোসেন (২৯) ভাইয়ের শহীদ হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘জিহাদ আমার ছোট ভাই। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই জিহাদ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ১৮ জুলাইয়ের আগে শহীদ মিনার এলাকায় আন্দোলনে ছিল জিহাদ। গত ১৮ জুলাই কাজলায় জিহাদের হাতে ছররা গুলি লাগে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারের সবাই জিহাদকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছে। সবাই ওকে বুঝিয়েছে যে, আন্দোলনে যাইস না। মানুষ মরতেছে। তবুও সে আন্দোলনে গেছে। ১৯ জুলাই বিকেল তিনটা পর্যন্ত বাড়ির সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। আর সে গুলিবিদ্ধ হয়েছে ৩.৪০ মিনিটে। সে সবাইকে বলেছে আন্দোলনে নামবে না। কিন্তু বিপ্লবী ও স্বাধীনচেতা মানুষ হওয়াতে প্রতিদিন রাজপথে নেমেছে সে।’
শেষ কথাগুলো
জিন্নাত বলেন, ‘মা ওকে ফোন দিলে জিহাদ মাকে বলতেন, ‘আমি স্বার্থপরের মতো বাসায় বসে থাকতে পারব না।’ আর ছোট চাচাকেও বলেছে, ‘আমার একটা বিবেক আছে, কাকা। এভাবে মানুষ মাইরা ফেলতেছে আমি ঘরে বইসা থাকতে পারব না। তোমরা আমাকে বাধা দিও না।’
১৯ জুলাই বিকেল ৩.৪০ মিনিটে ও গুলিবিদ্ধ হয়। এই খবর আমি ওর সহযোদ্ধার মাধ্যমে জানতে পারি। ফোন ধরেই ওই ছেলেটা কান্না করে ফেলছে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘মোল্লা জিহাদ গুলি খেয়েছে।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘গুলি কোথায় লেগেছে?’ ওরা বলল, ‘গুলিটি ডান পাঁজর দিয়ে ঢুকে ডান পাঁজরে আটকে ছিল।’
শেষ মুহূর্ত, জানাজা ও দাফন
পরে ওর সহযোদ্ধারা তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। সেখানে নেয়ার পর আইসিইউতে ঢুকানোর দুই মিনিটের মধ্যে দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় নেয় আমার একমাত্র আদরের ভাই জিহাদ। ওইদিন বিকেল ৫টার দিকে জিহাদ মারা যায়।
জিন্নাত আরো বলেন, ‘জিহাদের লাশ আনার জন্য আমাদের ঢাকায় যেতে হয়নি। ২০ জুলাই রাতে ওর সহযোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। পরে আমরা জানাজার নামাজ ঠিক করি সকাল ৯টায়। কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের চাপে সেটি আর পারিনি। তারা বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোররাতে জানাজা দিতে বাধ্য করে।’
তিনি বলেন, ‘জিহাদ মানবিক মানুষ ও জনপ্রিয় হওয়ায় এলাকাবাসীর চাওয়া ছিল ওর জানাজার নামাজ সকালবেলা হোক, যাতে সবাই অংশ নিতে পারে।
কিন্তু পুলিশ আমাদের হেনস্তা করে। ফলে ভোররাতে আমরা পারিবারিক কবরস্থানে জানাজা দিয়ে দাফন করেছি।’ কথাগুলো বলে কান্না শুরু করেন শহীদ জিহাদের বড় ভাই জিন্নাত।
রাজনৈতিক অবস্থান ও সহায়তা
শহীদ জিহাদ গণঅধিকার পরিষদের কবি নজরুল কলেজ শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক পদে থেকে রাজনীতি করতেন বলে জানিয়েছেন জিন্নাত হোসেন। তবে বিএনপি তাদের শহীদের তালিকায় জিহাদকে যুক্ত করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
জিন্নাত বলেন, ‘আমার ভাইয়ের রুহের মাগফিরাতের জন্য মিলাদ আয়োজন করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। ২০-২৫ জন পুলিশ এসে গালাগাল করেছে।
এমনকি, রাতে ঘরে ঘুমাতে দেয়নি। আমি ভাই হারিয়ে, বাবা-মা সন্তান হারিয়ে এমন নির্মম শোকের মধ্যেও পুলিশের হেনস্তার শিকার হয়েছি।’
ন্যায়বিচারের দাবি
জিন্নাত বলেন, ‘খুনি হাসিনার সহযোগী সকলকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিগত আমলে হাসিনাকে যারা মদদ দিয়েছে তারা প্রত্যেকেই দোষী। এরাই হাসিনাকে খুনি বানিয়েছে। সুতরাং এদের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। বর্তমান সরকারের কাছে শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে আমার চাওয়া, বিচার আগে, পরে অন্য কাজে জোর দিন।’
কোনো আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে জিন্নাত বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী থানায় ৮৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১০০ জনের বেশি অজ্ঞাতনামাকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। এতে প্রধান আসামি শেখ হাসিনা। আর তার খুনি মন্ত্রী পরিষদের শীর্ষ ১০ জন মন্ত্রীকে আসামি করা হয়েছে। তারা সবাই দোষী বলে মনে করছি। প্রমাণ করার দায়িত্ব বর্তমান সরকারের।’
সহায়তা ও প্রত্যাশা
জিহাদ শহিদ হওয়ার পরে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা দল কিংবা সংগঠন আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে জিন্নাত জানান, ‘সর্বপ্রথম আমাদের পাশে অর্থনৈতিক সহায়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তারা দুই লাখ টাকা সহায়তা প্রদান করেছে। তারপরে বিএনপি ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে। এরপর গণঅধিকার পরিষদ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে। আর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে।’
সরকারের কাছে কোনো প্রত্যাশা প্রসঙ্গে জিন্নাত বলেন, ‘বেশি কিছু চাই না। তবে জিহাদের আত্মত্যাগ যেন মানুষের মধ্যে অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকে, সেজন্য যেন সরকার কিছু করে। এটাই আমার ভাইয়ের জীবনের বিনিময়ে আমার চাওয়া।’
বাবা-মায়ের আকুতি
কান্নাজড়িত কণ্ঠে জিহাদের মা শাহিনূর বেগম (৫২) বলেন, ‘আমার ছেলে আমাকে অনেক যত্ন করত। আমি অসুস্থ বলে ডাল বাটতে পারি না। তাই রমজান মাসে আমার ছেলে ডাল বেটে পেঁয়াজু বানিয়ে আমাদের খাওয়াইছে। আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই রোজা রাখত। আমার ছেলেকে যারা খুন করেছে তাদের বিচার চাই। আর সরকারের কাছে একজন শহীদের মা হিসেবে আমার সন্তানের জন্য একটি সরকারি চাকরি চাই।’
শহীদ জিহাদের বাবা নুরুল আমীন মোল্লা (৫৭) বলেন, ‘আমার ছোট ছেলে জিহাদকে যারা হত্যা করেছে তাদের শাস্তি চাই। ছেলেকে তো আর পাব না। কিন্তু ছেলের খুনিদের বিচার দেখে মরতে চাই। আর সরকারের কাছে চাওয়া হলো তারা যেন আমার পরিবারের কাউকে একটা সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। আমার একটা মেয়েকে যোগ্যতা দেখে চাকরি দিলেই হবে। তাহলে আমরা বাকি জীবনটা নিশ্চিন্তে কাটাতে পারব।’