ওমরের স্মৃতিচিহ্নই এখন পরিবারের একমাত্র সম্বল

বাসস
প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৫, ১০:১০
শহীদ সাজিদুর রহমান ওমর -ছবি : বাসস

প্রতিবেদন: সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন

ঢাকা, ১৬ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া প্রতিশ্রুতিশীল ফ্রিল্যান্সার সাজিদুর রহমান ওমরের স্মৃতিচিহ্নগুলোই এখন তার পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। ওমরের রেখে যাওয়া কিছু সামগ্রীতে পরিবারের সদস্যরা তার অস্তিত্ব খুঁজে পান।

ডেমরার ডগাইর বাজার এলাকায় তাদের ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, টেবিলের ওপর রাখা আছে ওমরের ল্যাপটপ, ভিজিটিং কার্ড, পেশাগত পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও তথ্যপ্রযুক্তিতে তার দক্ষতার জন্য পাওয়া একটি স্বীকৃতিপত্র—যার মাধ্যমে তিনি ফ্রিল্যান্সিং করতেন।

ওমরের বড় ভাই রাজধানীর শেখ বোরহানউদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সিরাজুল ইসলাম (২৪)এখন তার ল্যাপটপটি ব্যবহার করছেন।

তিনি বলেন, ‘ল্যাপটপটি খুললে আমার ভাইয়ের অস্তিত্ব অনুভব করি, কারণ এতে ওমরের অনেক ছবি সংরক্ষিত আছে। এটি আমার ভাইয়ের ল্যাপটপ। ও এটি দিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করত। গ্রাফিক ডিজাইন, নেটওয়ার্কিং ও সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ে ছিল তার দক্ষতা।’

বুলেটের আঘাতে স্বপ্নভঙ্গ

ওমর ২১ জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ডিএমসিএইচ) বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।

সিরাজুল বলেন, ‘আমরা অন্যায়, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারী সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই আমরা সক্রিয় ছিলাম এবং এ আন্দোলনের সফলতা চেয়েছিলাম, যাতে অন্যায় থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই আমরা সবাই এতে অংশ নিয়েছিলাম।’

তিনি আরও জানান, আন্দোলনটি ১৭ জুলাই থেকে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। তখন পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়।

কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস—৫ আগস্ট ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটলেও দওমর সে বিজয় দেখে যেতে পারেনি।

সিরাজুল ও ওমর ১৯ জুলাই পৃথকভাবে ডেমরা রোডের কাজলা এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেন, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল।

সিরাজুল বলেন, ‘১৯ জুলাই কাজলা এলাকায় আমি ওমরকে স্লোগান দিতে দেখি। ওকে দেখে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, কারণ রাস্তায় তখন  ও বৃষ্টির মতো গুলি করা হচ্ছিল। আমার সামনেই অনেক মানুষ শহীদ হয় এবং অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে নেওয়া হয়।’

পরে তিনি ও তার বড় বোন মাহবুবা আক্তার ওমরকে রাস্তায় আন্দোলনে না যাওয়ার জন্য কঠোরভাবে নিষেধ করেন।

‘আমি শহীদ হবো’

‘আমার বড় বোন যখন ওমরকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করে, তখন সে জবাবে বলেছিল—'গুলিগুলো আমার পাশ দিয়ে চলে যায়, কিন্তু আমাকর গায়ে লাগে না। যদি কোনো গুলি আমাকে আঘাত করে, তবে তা হবে এক মহৎ বিষয়। আমি শহীদ হব।'

সিরাজুল জানান, ২১ জুলাই দুপুর ১টার দিকে ওমর জাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলনরত ছিল। সেদিন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা নিয়ে রায় ঘোষণা করে।

কিন্তু দুপুর ১টা ৩০ মিনিটের দিকে পরিবারের কাছে খবর আসে যে, ওমর জাত্রাবাড়ী-ডেমরা রোডে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তখন সিরাজুলও যাত্রাবাড়ীতেই ছিলেন।

‘আমি তৎক্ষণাৎ ঢাকা মেডিকেলে যাই এবং দেখি, ওমর লাইফ সাপোর্টে আছে, তার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, সে একেবারেই অচেতন। ডাক্তাররা তখনও নিশ্চিত ছিলেন না যে, গুলি মাথার ভেতরে আটকে আছে নাকি বেরিয়ে গেছে,’ বলেন তিনি।

ওই দিন বিকেলে ওমরকে ডিএমসিএইচ বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। ২১ জুলাই তার সিটি স্ক্যান করা হলে জানা যায়, গুলি মাথার ভেতর ঢুকে বেরিয়ে গেছে এবং তার মাথার খুলির দুটি অংশ আলাদা হয়ে গেছে।

‘ডাক্তাররা বলেছিলেন, সে যদি বেঁচে যায়, তাহলে পরে অস্ত্রোপচার করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার ভাই ২৪ জুলাই সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।’

শেষ বিদায়

সিরাজুল জানান, ওমরের প্রথম জানাজা ডগাইর এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়। পরে তারা তার লাশ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে তাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। ২৫ জুলাই সেখানে দ্বিতীয় জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

ওমর তার বাবা মো. শাহজাহান (৫৫), যিনি একসময় ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন, ও মা মোস্ত পারভিন আক্তার (৪৫), যিনি একজন গৃহিণী, এবং দুই বোন ও এক ভাই রেখে গেছেন।

স্বপ্নভঙ্গ, পরিবারের আর্থিক সংকট

ওমরের পরিবার জানায়, সে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখত এবং পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কোর্স করছিল। ২০২৩ সালে সে পাসপোর্ট তৈরি করেছিল। এ সময় সে একটি আইটি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং ফ্রিল্যান্সার হিসেবে একটি ব্রডব্যান্ড কোম্পানিতেও কাজ করছিল।

ওমরের বাবা শাহজাহান বলেন, ‘আমরা আমাদের ছোট ছেলেকে হারিয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ছি। সে আমাদের খুব আদরের ছিল, বিশেষ করে তার মায়ের কাছে। তার মা এখনও মানসিকভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।'

শাহজাহান আরও বলেন, ‘আমি এখন অসুস্থ, কাজ করতে পারি না। ওমর আমাদের পরিবারের মূল উপার্জনকারী ছিল। এখন তার মৃত্যু আমাদের আর্থিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। আমাদের বড় ছেলে সিরাজুল এখনও পড়াশোনা করছে এবং কাজ করতে পারছে না।’

তিনি আরও জানান, এখন তাদের পক্ষে বাড়ির ভাড়া পরিশোধ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

তবে, তিনি ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, যারা আন্দোলনে শহীদদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে।

শাহজাহান দেশবাসীর কাছে ওমরের আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া চান এবং তার হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবি জানান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
যুক্তরাষ্ট্রে ফায়ারিং স্কোয়াডে এক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
শেরপুরে বাণিজ্যিকভাবে হাইব্রীড ধান বীজ উৎপাদন শুরু
নিম্ন আদালত মনিটরিংয়ে হাইকোর্টের ১৩ বিচারপতি
জনগণ বিচার বিভাগের ওপর হারানো আস্থা ফিরে পাবে: প্রধান বিচারপতি
নদীতে ফুল উৎসর্গে মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’
ট্রাম্পকে হত্যার ষড়যন্ত্রে এক ব্যক্তি অভিযুক্ত: মার্কিন বিচার বিভাগ
ইসরাইলি হামলায় গাজায় একই পরিবারের ১০ জন নিহত
শেরপুরের ঝিনাইগাতীর মিনি চিড়িয়াখানা থেকে ১৭টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার
দিন ও রাতের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে
ভোলায় সড়ক দুর্ঘটনায় একজন নিহত
১০