শিশুকন্যাকে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে শহীদ ওয়াসিমের স্ত্রী

বাসস
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৫, ১৩:১৩ আপডেট: : ১৭ মার্চ ২০২৫, ১৩:২২
শহীদ মো. ওয়াসিম শেখ -ছবি : ষংগৃহীত

প্রতিবেদন: সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন

ঢাকা, ১৭ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : রাজধানীর ফুটপাথে প্যান্ট বিক্রেতা মো. ওয়াসিম শেখ (৩৮) ছাত্রর-জনতার গণ-আন্দোলনে শহীদ হওয়ার পর তার বিধবা স্ত্রী রেহানা আক্তার বাবাহারা দুধের শিশু একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিয়ে এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি।

গত ১৮ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় ওয়াসিম গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এর আগে ১৭ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায় এবং দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণ আন্দোলনে যোগ দেন।

প্রাথমিকভাবে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন পরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিণত হয় এবং ৫ আগস্ট ২০২৪, প্রায় ১৬ বছর দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পতন ঘটে।

ওয়াসিমের পরিবারে রয়েছেন, তার স্ত্রী রেহানা আক্তার (৩৩), একমাত্র কন্যা এগার মাস বয়সী তাসনিয়া শেখ, মা জোসনা বেগম (৫০) ও ছোট ভাই আবু বকর (২৩)।

শহীদ মো. ওয়াসিম শেখের স্ত্রী ও কন্যা -ছবি : বাসস

একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তারা চরম অনিশ্চয়তা ও অসহনীয় কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

ওয়াসিম তার বাবার মৃত্যুর মাত্র চার মাসের মধ্যেই শহীদ হন। ফলে পরিবারটি এক বিপর্যয় কাটিয়ে না উঠতেই অন্য বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।

পানি বিতরণ করতে গিয়ে মৃত্যু

ওয়াসিমের শোকার্ত স্ত্রী রেহানা আক্তার বাসসকে জানান, ‘১৮ জুলাই বিকাল ৪টার দিকে আমার স্বামী শানির আখড়ায় তার ফুটপাথের দোকান দেখতে বাসা থেকে বের হন।

কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তিনি বিক্ষোভকারীদের মাঝে পানি বিতরণ করতে যান। ওই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়।’

তিনি বলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে ওয়াসিমের ভগ্নিপতি মো. জসিম, যিনি পরিবার নিয়ে অন্যত্র থাকেন, আমাকে জানান, ওয়াসিম গুলিবিদ্ধ হয়ে শানির আখড়ার অনাবিল হাসপাতালে আছেন।’

জসিম জানান, ‘সেদিন বিকাল ৫টার দিকে ওয়াসিমের পাশের এক দোকানদার আমাকে ফোন করে এই দুঃসংবাদ দেন। আমি অনাবিল হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) স্থানান্তর করা হয়।’

‘ছবিতে দেখা যায়, তার মাথায় গুলি ঢুকে দু’ভাগ হয়ে যায়, মগজ বেরিয়ে আসে,’ বলেন জাসিম।

পরে তিনি ও তার বোন ঢামেকে গিয়ে জরুরি বিভাগের গেটে একটি অ্যাম্বুলেন্সে ওয়াসিমের নিথর দেহ দেখতে পান। কর্তব্যরত চিকিৎসক তখন তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

লাশ পেতে দুর্ভোগ

জসিম জানান, ‘১৮ জুলাই আমরা যখন যাত্রাবাড়ী থানায় যাই, তখন পুলিশ স্টেশনে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কোনো সহায়তাও দেওয়া হয়নি।’

‘পরদিন থানার এক কর্মকর্তা ঢামেকে গেলে হাসপাতালের এক কর্মচারী আমাদের তাকে খুঁজে নিতে বলেন। পরে সেই পুলিশ কর্মকর্তার অনুমতি পেয়ে ওয়াসিমের লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য নেওয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘শুক্রবার (১৯ জুলাই) বিকেলে লাশ হাতে পাই। কিন্তু এর জন্য আমাদের ১২ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।’ ওই দিন মাগরিবের নামাজের পর মাতুয়াইল কবরস্থানে ওয়াসিমকে দাফন করা হয়।

মেয়ের মুখে বাবা ডাক শোনা হলো না

কান্নাজড়িত কণ্ঠে রেহানা বলেন, ‘তাসনিয়া আমাদের বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত সন্তান। তার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল তাকে ঘিরে।’ 

রেহানাআরও বলেন, ‘আমাদের বিয়ে হয়েছে নয় বছর। আট বছর ধরে আমরা সন্তানের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ আমাদের কন্যাসন্তান দিয়েছেন। কিন্তু তার তিন মাসের মধ্যেই সে বাবা হারিয়েছে। শিশুটি ‘বাবা’ শব্দটি উচ্চারণ করার আগেই তার বাবা তাকে ছেড়ে চলে গেলেন।’

দুঃসহ আর্থিক সংকট

পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিওয়াসিম পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। তার দুই বোন বিবাহিত। পাঁচ বছর আগে স্ট্রোক করার পর তার বাবা গুলিস্তানে ফুটপাথে ছোটখাট প্যান্টের ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ফলে পরিবারের ছয় সদস্যের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন ওয়াসিম।

তার মৃত্যুতে পরিবার চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। স্ত্রী, শিশুকন্যা, ছোট ভাই ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে রেহানা এখন দিশেহারা। ওয়াসিমের ছোট ভাই আবু বকর মাতুয়াইলের আহমদবাগ এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকেন। তিনি এখনও বেকার।

রেহানা বলেন স্বামীর মৃত্যুর পর আমি শিশু সন্তানটির জন্য ঠিকমতো দুধও কিনতে পারছি না। প্রতি চার দিনে এক প্যাকেট গুঁড়ো দুধ প্রয়োজন।’

‘আমাদের চার সদস্যের পরিবারের এখন দু’মুঠো খাবার জোগাড় করাও কষ্টকর,’ বলেন রেহানা। সংসার চালাতে তারা আগের বাসা ছেড়ে কম ভাড়ার একটি বাসায় উঠতে বাধ্য হয়েছেন।

ওয়াসিমের ফুটপাথের দোকান থেকে মাসে মাত্র ৪ হাজার টাকা ভাড়া আসে, যা তাদের সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়। এখন তারা বলতে গেলে আত্মীয়-স্বজনদের সহায়তার ওপরই নির্ভরশীল।

‘আমার দেবরও কিছু কাজের চেষ্টা করছে। কিন্তু মূলত আমরা এখন আত্মীয়দের সাহায্যেই বেঁচে আছি,’ বলেন রেহানা। তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে এই সহায়তা বেশি দিন পাওয়া যাবে না।

গ্রামে ফেরার পথ নেই

তাদের আদি নিবাস মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায়। তবে বহু বছর আগেই নদীভাঙনে তারা জমি ও বাড়িঘর হারিয়েছেন।

গভীর শোক ও অনিশ্চয়তায় ভারাক্রান্ত কণ্ঠে রেহেনা বলেন, ‘আমাদের গ্রামে ফেরার কোনো উপায় নেই।’ মেয়ের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য সরকারের সহায়তা চান তিনি।

ন্যায়বিচারের দাবি

রেহানা তার স্বামীর হত্যার বিচার চেয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করেছেন। এতে ৪৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং আরও ১০০-১৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রমূখ।

রেহানা বলেন, ‘আমি আমার স্বামীর হত্যার বিচার চাই এবং দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানাই।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
যুক্তরাষ্ট্রে ফায়ারিং স্কোয়াডে এক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
শেরপুরে বাণিজ্যিকভাবে হাইব্রীড ধান বীজ উৎপাদন শুরু
নিম্ন আদালত মনিটরিংয়ে হাইকোর্টের ১৩ বিচারপতি
জনগণ বিচার বিভাগের ওপর হারানো আস্থা ফিরে পাবে: প্রধান বিচারপতি
নদীতে ফুল উৎসর্গে মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’
ট্রাম্পকে হত্যার ষড়যন্ত্রে এক ব্যক্তি অভিযুক্ত: মার্কিন বিচার বিভাগ
ইসরাইলি হামলায় গাজায় একই পরিবারের ১০ জন নিহত
শেরপুরের ঝিনাইগাতীর মিনি চিড়িয়াখানা থেকে ১৭টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার
দিন ও রাতের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে
ভোলায় সড়ক দুর্ঘটনায় একজন নিহত
১০