লালমিয়াকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন স্ত্রী আম্বিয়া বেগম

বাসস
প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৫, ১৯:৫২
শহীদ লাল মিয়া, ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : মহিউদ্দিন সুমন

টাঙ্গাইল, ২০ মার্চ ২০২৫ (বাসস) : স্বামী লাল মিয়া (৪৫)কে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন স্ত্রী মোছাম্মৎ আম্বিয়া বেগম। এত তাড়াতাড়ি আনন্দের সংসারে বিষাদ নেমে আসবে, তা কখনও ভাবতে পারেননি তিনি। এখন তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার।

সংসারের একমাত্র রোজগারের মানুষটি না থাকায় করুণ অবস্থায় দিন পার করছে তার পরিবার। উপার্জনক্ষম স্বামীকে হারিয়ে যেন পুরো পরিবারেই অন্ধকার নেমে এসেছে। শোকে পাথর বনে গেছেন লালমিয়ার স্ত্রী।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের আগের দিন দুপুরে ঢাকা থেকে ব্যবসার কাজ শেষ করে টাঙ্গাইলে বাড়ি ফেরার পথে গাজীপুর-মাওনা চৌরাস্তার পল্লীবিদ্যুৎ মোড় এলাকায় স্বৈরাচার পতনের উত্তাল মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গোলাবাড়ি ইউনিয়নের মাঝিরা গ্রামের লালমিয়া (৪৫)।

সম্প্রতি সরেজমিনে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গোলাবাড়ি ইউনিয়নের মাঝিরা গ্রামে লালমিয়ার বাড়িতে তার স্ত্রী আম্বিয়া বেগমের সঙ্গে আলাপ হয় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের।

লালমিয়ার স্ত্রী আম্বিয়া বেগম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। আমার স্বামী খুবই সহজ-সরল একজন মানুষ ছিলেন। তিনি পেশায় ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ঢাকায় মুরগির ব্যবসা করতেন। কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।

কেন আমার স্বামীকে এভাবে গুলি করে মেরে ফেলল? কী দোষ ছিল তার? কেন তাকে গুলি করে হত্যা করা হলো? আমি স্বামীর হত্যার বিচার চাই।’

লালমিয়ার স্ত্রী সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘সেদিন ছিল স্বৈরাচারবিরোধী একদফা আন্দোলনে উত্তাল ৪ আগস্ট। সকাল থেকেই ছাত্র-জনতার দখলে ছিল গাজীপুর-মাওনা চৌরাস্তা। হাজারো জনতা পল্লীবিদ্যুৎ মোড় এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন। লাল মিয়া সেদিন ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় দুপুরে মুরগি বিক্রি করে টাঙ্গাইলের বাড়ি ফেরার উদ্দেশে রওনা দেন।

শহীদ লাল মিয়ার স্ত্রী ও সন্তান, ছবি : বাসস

গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় তাকে কখনো ভ্যানে, কখনো সিএনজিতে ভেঙে ভেঙে টাঙ্গাইলের দিকে আসতে হচ্ছিল। কোনো গাড়ি না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে রওনা দেন তিনি।

সর্বশেষ পল্লীবিদ্যুৎ মোড় এলাকায় পৌঁছালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মিছিলে জড়িয়ে পড়েন লাল মিয়া। এ সময় পুলিশ সদস্যরা এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। হঠাৎ লাল মিয়া পেটে গুলিবিদ্ধ হন এবং রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন।

লালমিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ তখন পাশে ছিলেন না। দীর্ঘ সময় রাস্তায় পড়ে থাকেন তিনি। পরে এক ভ্যানচালক গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।

সেখানে আইসিইউতে দুই দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে না ফেরার দেশে চলে যান লালমিয়া। পরদিন ৬ আগস্ট মধুপুরের মাঝিরা গ্রামে এশার নামাজের পর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।

আম্বিয়া বেগম বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে লামিয়া (২১)কে আগেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। বর্তমানে মেঝ মেয়ে নুমিয়া (১৫) এবং একমাত্র ছেলে আব্দুল আহাদ (১১) স্থানীয় কাশিপুর মডেল মাদ্রাসায় পড়ছে।'

তিনি বলেন, 'স্বামীর রেখে যাওয়া চার শতাংশ বসতভিটা ছাড়া আমাদের আর কোনো জায়গা-জমি নেই। আমার স্বামী বেঁচে থাকলে সন্তানদের পড়ালেখা ও সংসারের খরচ নিয়ে আমাকে ভাবতে হতো না। এখন সরকার যেন আমাদের দিকে একটু দৃষ্টি দেয়, আমরা সেই অপেক্ষায় আছি।’

তিনি আরও জানান, ‘স্বামী লালমিয়ার মৃত্যুর পর স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দল আমাদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা, স্থানীয় বিএনপির পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা এবং স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকার অনুদান পেয়েছি আমরা।’

লালমিয়ার বড় মেয়ের জামাই রবিউল ইসলাম সোহাগ বলেন, ‘ঘটনার দিন শ্বশুরকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে হাসপাতাল থেকে শ্বশুরের মোবাইল ফোন থেকে একজন প্রথমে আমাকে জানায় যে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

খবর পাওয়ামাত্র আমরা সেখানে ছুটে যাই। তখন ডাক্তার জানালেন, শ্বশুর লাল মিয়ার পেটে, নাভীর কাছে একটি গুলি লেগেছে। পরে অপারেশনের পর তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। সেখানে দুই দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি মারা যান।

আমার শ্বশুর অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। বড় জামাই হিসেবে আমাকে খুব ভালোবাসতেন। সব সময় ফোন দিয়ে আমাদের খোঁজ-খবর রাখতেন। সেদিন বারবার ফোন দিয়ে বলছিলাম, আজ টাঙ্গাইল যাওয়ার দরকার নেই। আমার বাসায় থাকুন। পরিস্থিতি ভালো হলে যাবেন। কিন্তু তিনি আমার কথা শোনেননি।’

লালমিয়ার ভাতিজা সুজন আলী বলেন, ‘চাচা খুব সহজ-সরল ও সৎ মানুষ ছিলেন। ছোটবেলা থেকে তাকে কোনো অন্যায় কাজে যুক্ত হতে দেখিনি। এমনকি কখনো কারও সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করতেও দেখিনি।’

লালমিয়ার ছেলে আব্দুল আহাদ (১১) বলেন, ‘বাবা আমাদের সবাইকে অনেক ভালোবাসতেন। যখন যা প্রয়োজন, তা আমাদের কিনে দিতেন। আজ বাবা নেই। তিনি এ দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন, আর আমাদের মাঝে আসবেন না—এটা ভাবলেই কান্না পায়।

তবে আমার একটাই দাবি, বাবার হত্যাকারীদের বিচার চাই। সেই সঙ্গে সরকার যেন বাবাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়। সবাই বাবার জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন।’

মধুপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জুবায়ের হোসেন বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার একজন নিহত এবং ১৪ জন আহত হয়েছেন।

শহীদ লালমিয়ার পরিবারকে ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। এছাড়া লালমিয়ার স্মৃতি ধরে রাখতে তার বাড়িতে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি সাবমার্সিবল পানির পাম্প বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে তার পরিবার এবং আশপাশের এলাকার মানুষ বিনামূল্যে সেই পানি ব্যবহার করতে পারবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘লালমিয়ার ছেলে-মেয়েদের মাদ্রাসায় বিনাবেতনে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। লালমিয়া দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। তার এই আত্মত্যাগ কখনও ভোলার নয়। আমি তার পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
ইসরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নেত্রকোনায় কবি-লেখকদের প্রতিবাদ 
সাবেক সংসদ সদস্য মোরশেদ আলম গ্রেফতার
বাংলাদেশে ফিনল্যান্ডের দূতাবাস খোলার অনুরোধ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার
সিলেটে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার
পাঁচ জেলায় পরিবেশ দূষণরোধে মোবাইল কোর্ট, ৪৪ লাখ টাকা জরিমানা
ভবিষ্যত বাংলাদেশের রোডম্যাপ তৈরি করবে ঐকমত্য কমিশন : আলী রীয়াজ
বঙ্গোপসাগর থেকে ২১৪ জনকে আটক করেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী
রাশিয়ায় পাঁচ বাংলাদেশি পেশাজীবী পুরস্কৃত
লক্ষ্মীপুরে পাচারকালে ৬টি গুইসাপসহ তিনজন আটক
জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতি তহবিলে ক্ষতিগ্রস্তদের সরাসরি অর্থায়নের দাবি ইয়ুথনেটের
১০