শহীদি মৃত্যু কামনাই যেন পূরণ হলো আলী রায়হানের

বাসস
প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৫৭
শহীদ আলী রায়হান -ছবি : বাসস

প্রতিবেদন: ওমর ফারুক

রাজশাহী, ৮ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : ষৈম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন আলী রায়হান (২৮)। আন্দোলনের সহযেদ্ধিাদের তিনি প্রায়ই বলতেন, যদি কেউ শহীদ হন, তবে যেন সেই সৌভাগ্য তার হয়। শেষ পর্যন্ত যেন ঠিক সেই চাওয়া পূরণ হলো। ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে নিহত হয়ে শহীদের মর্যাদা অর্জন করেছেন তিনি।

একটি ভালো চাকরি করে দরিদ্র বাবা-মায়ের কষ্ট লাঘব করার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর বাস্তব হলো না। গুলিবিদ্ধ হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে আসে পরিবার ও রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের মাঝে।

দরিদ্র বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন মুহূর্তেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। কিন্ত আল্লাহ তায়ালা যেন তার শহীদি মৃতু কামনা কবুল করেছেন। 

শহীদ আলী রায়হান রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার মঙ্গলপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মো. মুসলেম উদ্দিন ও মায়ের নাম মোসাম্মৎ রোকসানা বিবি। তারা দুই ভাই। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। ছোট ভাইয়ের নাম মো. রানা ইসলাম। রানা একটি ছোট ব্যবসা করতেন। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছেন।

আলী রায়হান গ্রামের স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেন। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে মেধার স্বাক্ষর  রাখেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য বাবা-মা ও ছোট ভাইকে ছেড়ে আসেন শিক্ষা নগরী রাজশাহীতে। 

ভর্তি হন দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগে। এ কলেজ থেকে অনার্স করার পর ২০২৩ সালে মাস্টার্স শেষ করেন। এরপর তিনি একটি কোর্সে ভর্তি হন। সম্প্রতি একটি চাকুরির কথাবার্তা চলছিল তার। এরই মধ্যে আন্দোলনে শহীদ হন।

আলী রায়হান পড়াশোনার পাশাপাশি ইসলামী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির করতেন। প্রথমে  রাজশাহী কলেজ শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ও পরবর্তীতে রাজশাহী মহানগর শাখা ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছিলেন। সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে শহীদ হন। তার মৃত্যুতে সংগঠন ও পরিবারের শোকের ছায়া নেমে আসে।

দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে আলী রায়হানের অন্যতম সঙ্গী ও সহযোদ্ধা রাজশাহী মহানগর শাখা ছাত্রশিবিরের বর্তমান আইন ও প্রশিক্ষণ সম্পাদক নাজির আহমেদ সুপ্ত। তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) কে বলেন, আলী রায়হান ভাই খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মানুষ হিসেবেও ছিলেন নম্র, ভদ্র। সংগঠনভক্তি ছিল খুব। সংগঠনের কাজের জন্য বাড়িতে খুব কম যেতেন। জুলাই বিপ্লবে আন্দোলনের সময় মিটিং-মিছিলে তিনি সবসময় সামনের সারিতে থাকতেন। 

৫ আগস্ট দুপুরে গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগের রাতে আলী রায়হান ভাইসহ আমরা ৪ জন একসাথে ছিলাম। ফজরের নামায শেষে মোনাজাতে তিনি শহীদি মৃত্যুর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। নামাজ শেষে সবার কাছে মাফ চেয়ে বলেন, দেশের পরিস্থিতি ভালো নয়, কখন কি হয় বলা যায় না। সবাই আমাকে মাফ করে দিয়েন। ৫ আগস্ট সকালে তিনি নাশতা না করেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে যান।

তিনি আরও বলেন, আমরা মিছিল নিয়ে রাজশাহী মহানগরের আলুপট্টির দিকে যাচ্ছিলাম। আলী রায়হান ভাই আমার থেকে একটু সামনে ছিলেন। আমরা মিছিল নিয়ে এগোচ্ছিলাম।

মিছিলটি আলুপট্টি মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছলে আমাদের উপর ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা মুহুর্মূহু গুলি ছুঁড়তে থাকে। সাথে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের মদদপুষ্ট পুলিশ বাহিনী ছিল। কিছু অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্য আমাদের ওপর হামলা চালাচ্ছিল। আমরা ছিলাম নিরস্ত্র।

দুপুর সোয়া ১টা নাগাদ মিছিলটি আরও সামনের দিকে এগোনোর সময় ছাত্রলীগ-যুবলীগ সন্ত্রাসীদের গুলি এসে আলী রায়হান ভাইয়ের কপালে এসে লাগে। সাথে সাথে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ওই সময় আমাদের আরেকজন ভাইয়ের হাতেও গুলি লাগে। পরে আরও বেশ কয়েকজন আহত হন।

আলী রায়হানকে একটি মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানান। সেই সাথে জানিয়ে দেন যে, এই অপারেশন হাসপাতালে হবে না। উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিতে যেতে হবে। 

নাজির আহমেদ সুপ্ত বলেন, আমরা এয়ার এ্যাম্বুলেন্স জোগাড়ের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। আমরা ভাইকে নিয়ে একটি অ্যাম্বু্লেেন্স করে ঢাকায় রওনা দেই। পথে তালাইমারী মোড় পার হওয়ার সময় কিছু হঠকারী বিক্ষোভকারী আমাদের অ্যাম্বুলেন্সটিকে না জেনেশুনে ভেঙে ফেলে। সেই এ্যাম্বুলেন্সে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আর অবস্থা ছিল না।

এরপর আমরা ভাইকে নিয়ে নওদপাড়া ইসলামী হাসপাতালে যাই। 

এর মধ্যেই রামেক হাসপাতাল থেকে ভাইয়ের অপারেশন করার সিদ্ধান্ত জানান চিকিৎসকরা। আমরা আবার তাকে রামেক হাসপাতালে নিয়ে আসি। সেখানে তার অপারেশন সাকসেসফুল হয়। মনে হচ্ছিল তিনি আগের থেকে সুস্থ হচ্ছেন। কিন্ত না, ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউতে) তার মৃত্যু হয়। 

তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সংগঠন ও পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে। পরদিন ৯ আগস্ট রাজশাহী কলেজ মাঠে তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ও স্থানীয় জামায়াত বিএনপির নেতৃবৃন্দ এবং হাজার হাজার মানুষ এ জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। জানাজা শেষে তাকে পুঠিয়ার মঙ্গলপাড়ায় নিজ গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়।

নাজির আহমেদ সুপ্ত আরও বলেন, আলী রায়হান হত্যার ঘটনায় নগরের বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সেই মামলার উল্লেখযোগ্য আসামির মধ্যে এক যুবলীগ সন্ত্রাসী ও আরেক আ’লীগ নেতা আটক হয়েছে। আর কেউ ধরা পড়েনি। আমরা প্রশাসনের কাছে সকল আসামিকে অল্প সময়ের মধ্যে আটকের দাবি জানাচ্ছি। সেই সাথে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও দাবি জানাচ্ছি।

শহীদ আলী রায়হানের ছোট ভাই রানা ইসলাম বাসসকে বলেন, ভাইয়া খুব ভালো মানুষ ছিল। যারা ভাইয়াকে হত্যা করেছে তাদের কঠোর শাস্তির দাবি করছি, যাতে আর কাউকে এভাবে মরতে না হয়। ভাইয়ার বিদেশে যাওয়ারও ইচ্ছে ছিল। সেটি পূরণ হলো না।

এদিকে,পবিত্র রমজান মাস শেষে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হলো। দুই ঈদেই আলী রায়হানের সাথে তার বাবা-মায়ের বেশি দেখা হতো। কিন্ত এবার তা হলো না। এটি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তার মা-বাবা। 

মা-বাবা আশায় থাকেন এই বুঝি তাদের সন্তান ফিরে আসবে। সন্তানের আশায় পথ চেয়ে থাকেন সবসময়। ঈদে সন্তানকে এবার দেখতে পাবেন না এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর হচ্ছে তাদের কাছে।

আলী রায়হানের মায়ের প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে ছিলেন না। তার বাবা মো. মুসলেম উদ্দিন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) কে বলেন, আমরা সন্তান হারিয়ে যে কষ্টের মধ্যে আছি তা কাউকে বলে বোঝানোর মতো নয়।

তিনি বলেন, সন্তানকে তো আর ফিরে পাবো না। যারা আমাদেরকে সন্তানহারা করেছে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি।

অনেক আসামি ধরা ছোঁয়ার বাইরে আছে তাদেরও আটকের দাবি জানাচ্ছি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের সাঁড়াশি অভিযান ৬৫ জন গ্রেফতার
আওয়ামী লীগ নেতা রানার অপহরণের বিবরণ ভিত্তিহীন : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং
বিশেষ অভিযানে ১৯ জন গ্রেফতার 
ভোলাগঞ্জে পাথর লুটপাটে জড়িত ১৪ জনের কারাদণ্ড
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বজ্রপাতে ৩ ব্যক্তির মৃত্যু
সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যা মামলায় ৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ
নির্বাচন কমিশনের সামনে এনসিপির বিক্ষোভ সমাবেশ কাল
টিএনজেড ও মাহমুদ গ্রুপের সম্পত্তি বিক্রি করে শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধ করা হবে : শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা
৪৩তম বিসিএসে ১৬২ জনকে নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি  
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত নরওয়ের
১০