প্রতিবেদন: রুপোকুর রহমান
সাভার, ১২ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : বাবা জাহিদুল ইসলামের মৃত্যুতে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ১০ বছরের শিশু কন্যা জাহিদার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আশুলিয়া থানার মোড়ে গুলিতে প্রাণ হারান জাহিদুল ইসলাম। স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী রিনাও যেন পড়েছেন অথৈ সাগরে। অন্ধকার দেখছেন ভবিষ্যৎ। উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে অসুস্থ বাবা-মাও যেন হয়ে পড়েছেন অসহায়।
জাহিদুল ইসলাম (২৮) গ্রামের বাড়ি রংপুর জেলার বদরগঞ্জ থানার আমরুলবাড়ী হাটখোলাপাড়া গ্রামে। স্ত্রী রিনা ও দশ বছর বয়সী মেয়ে জাহিদাকে নিয়ে থাকতেন আশুলিয়ার বসুন্ধরা নতুনবাজার এলাকায়।
জাহিদের বাবার নাম রফিকুল ইসলাম (৬০), মায়ের নাম আমেনা বেগম (৪৪)। দাদা মৃত শাহাবুদ্দিন, দাদী মৃত রহিমা খাতুন। নানার নাম মৃত আমীর হোসেন, নানী রোকেয়া বেগম (৭০)।
আলমগীর ও আনোয়ারুল নামের আরও দুজন ছোট ভাই রয়েছে জাহিদুলের। স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে পেশায় নরসুন্দর (নাপিত) জাহিদুলের সংসার ভালোই চলছিল। তিনজনের ছোট্ট পরিবারটি ছিল শান্তিপূর্ণ।
অদম্য সাহসী জাহিদুল অন্যদের সঙ্গে প্রায়ই অংশ নিতেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। প্রতিবাদী মিছিলের অগ্রভাগেই দেখা যেত তাকে। বাসায় ফিরে স্ত্রী-স্বজনদের শুনাতেন সেই গল্প।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্থানীয় ছাত্র-জনতার সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। মিছিলের সামনের সারিতেই ছিলেন সেদিনও। বিকেলে আশুলিয়া থানার মোড়ে জাহিদুল মাথায় গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। ৫ আগস্ট রাতেই শহীদ জাহিদুল ইসলামকে আশুলিয়ার বসুন্ধরা নতুনবাজার এলাকায় দাফন করা হয়।
জাহিদুলের মৃত্যুতে পরিবারটি যেন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। বাবার কথা বলতে গিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছে শিশু জাহিদা। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছে। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে সে- কিছুই বলতে পারছে না।
শহীদ জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী রিনা বাসসকে জানান, ‘আমার স্বামী আশুলিয়া এলাকায় নরসুন্দরের কাজ করত। মাঝেমাঝেই ছাত্র-জনতার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে চলে যেত। বারবার নিষেধ করলেও শুনত না।’
রিনা বলেন, ‘৫ আগস্টও আন্দোলনে যায়। মাথায় গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আমাদের একটি মেয়ে আছে, ওর বয়স ১০ বছর। মাদ্রাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। এখন কীভাবে মেয়েকে নিয়ে চলবো জানি না। ওর পড়াশোনা চালাতে পারবো কি না, সেটাও জানি না। সংসার কিভাবে চলবে?’
তিনি স্বামীর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান এবং মেয়ের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারের কাছে স্থায়ী সহায়তার আবেদন করেন।
শহীদ জাহিদুল ইসলামের শ্যালক হাবিব মিয়া বাসসকে বলেন, ‘দুলাভাই ছিলেন খুব ভালো মানুষ। তার মৃত্যুর পর বোনের পরিবারটি ভেঙে পড়েছে। ছোট্ট একটা মেয়ে রয়েছে। বোন এখন কোথায় দাঁড়াবে? ভবিষ্যত কী হবে? সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে।’
ছোট ভাই আনোয়ারুল বলেন, ‘আমার ভাই ছিল অদম্য সাহসী। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই অংশ নিত। ভয় তাকে থামাতে পারেনি। মিছিলের সামনের সারিতেই থাকত। ঘাতকরা নির্মমভাবে তাকে হত্যা করেছে। এখন ঘরে অসুস্থ বাবা-মা। তাদের ভরণপোষণ কীভাবে হবে? চিকিৎসা ও খাবারের টাকা জোগাড় করাই এখন সমস্যা। ভাইয়ের মৃত্যুতে ভাবি আর ভাতিজি অসহায় হয়ে গেছে। সংসার এলোমেলো হয়ে গেছে।’
মা আমেনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে জাহিদুল আমাদের খোঁজ-খবর রাখত, সংসার চালাত। ওরা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। এখন আমরা কী করবো? আমার স্বামী অন্ধ, বিভিন্ন রোগে ভুগছে। ওষুধ কিনবো কীভাবে? খাবার জোগাড়ই বা হবে কেমন করে?’
আমেনা বেগম বলেন, ‘আমি সরকারের কাছে আমার ছেলের স্ত্রী ও সন্তানের পাশাপাশি নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য সহায়তার আবেদন জানাচ্ছি। হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি চাই।’
সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার ছেলে ছিল সাহসী। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেও সে মিছিলে সামনের সারিতে থাকতো। দেশের জন্য গুলি খেয়ে মরতে হলো তাকে।’
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি চোখে দেখি না। এখন আমাদের বেঁচে থাকাই দায়। ওষুধ খেতে হয়, অভাব লেগেই থাকে। আমাদের দেখভালের দায়িত্ব কে নেবে? ছেলের হত্যার বিচার না দেখে মরতে চাই না।’
শহীদ জাহিদুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনায় তার ছোট ভাই আনোয়ারুল ৭৪ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
পরিবারটি জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা এবং জামায়াতে ইসলাম থেকে ২ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা পেয়েছে।