প্রতিবেদন : বাবুল আখতার রানা
নওগাঁ, ২০ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : পড়ালেখা করে বড় অফিসার হওয়ার স্বপ্ন ছিল মেধাবী ছাত্র শ্রাবণের। বাড়ির পাশের কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর স্বপ্নপূরণের আশায় উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান রাজধানী ঢাকায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিজের যাবতীয় স্বার্থ ও স্বপ্ন-সাধকে তুচ্ছ করে মা-বাবা, ভাইয়ের আকুতি উপেক্ষা করে দেশের জন্য জীবন দিয়ে শহীদ হয়ে নিঃস্বার্থ ও নির্ভেজাল দেশপ্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মাহফুজ আলম শ্রাবণ (২১)।
ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে চব্বিশের ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন নওগাঁর তরুণ মাহফুজ আলম শ্রাবণ (২১)।
মহাদেবপুরের রাইগাঁ ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আরিফুর রহমান সরদার বলেন, 'শহীদ মাহফুজ আলম শ্রাবণ মেধাবী ছাত্র ছিল। সে আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এইচএসসি পাস করেছে। তার ইচ্ছে ছিল একজন বড় অফিসার হবে। কিন্তু নিজের স্বপ্ন পূরণের চেয়ে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে, দেশের স্বার্থে জীবন দিয়ে সে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।'
শ্রাবণের খুনের যেন বিচার এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিহত সকলকে রাষ্ট্রীয়াবে শহীদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
চব্বিশের ৫ আগস্ট দুুপুরে ঢাকার মিরপুর ১০-এ পুলিশের গুলিতে প্রথমে আহত হন। আহত অবস্থায় ছাত্র-জনতা তাকে ঢাকার ডা. আজমল হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মাহফুজ আলম শ্রাবণ নওগাঁ সদর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের দোগাছি গ্রামের মোশারফ হোসেনের ছেলে। তারা তিন ভাই। শ্রাবণ দ্বিতীয়। শহীদ শ্রাবণের বাবা মোশারফ হোসেন একজন মটর মেকানিক। সে সুবাদে শ্রাবণ বাবার সাথে নওগাঁর মহাদেবপুরে থাকতেন।
শহীদ শ্রাবণ ২০২১ সালে মহাদেবপুর সর্বমঙ্গলা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০২৪ সালে মহাদেবপুরের রাইগাঁ ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
শহীদ শ্রাবণের মা বেবী নাজনিন (৪৬) বাসসকে বলেন, গত ৪ আগস্ট রাত ৮টার দিকে মাহফুজ আলম শ্রাবণ তাকে ফোন দিয়ে বলেছিল, 'মা, তুমি কেমন আছ? কী খেয়েছ?' তখন শহীদ মাহফুজ আলম শ্রাবণের মা কিছুটা অসুস্থ ছিল।
তিনি শ্রাবণকে বলে দেশের অবস্থা ভালো নয় বাবা; সাবধানে থেকো। যেহেতু তোমার অফিস ৪ দিবন্ধ সেহেতু বাসায় থেকো। বাইরে যেও না।'
মায়ের কথাগুলো শুনে শ্রাবণ বলেন, 'মা আমি তোমার সন্তান। তোমার মত অনেক মায়ের সন্তান এই দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। তাহলে কেনো আমি আন্দোলনে যাব না। সব সময় তুমি নিজের কথাটা ভাব। দেশের কথা ভাব না কেনো? যারা শহীদ হয়েছেন তারাও তো অনেক মায়ের সন্তান। তুমি তোমার ছেলের পাশাপাশি তোমার সুন্দর দেশটার কথাও ভাব।
শ্রাবণ আরও বলেন, 'তুমি এত স্বার্থপর কেনো মা। আমি কালকে আন্দোলনে যাব। তুমি যতই নিষেধ করো না কেনো আমি শুনব না।' এরপর মা তার ফোনটা বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পিকে দিয়ে বলেন, 'তোর ভাইকে বোঝা- দেশের অবস্থা ভালো নয়, সে যেন আন্দোলনে না যায়।
শহীদ শ্রাবণের মা আরও বলেন, 'আমার সন্তান দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। আমার ছেলেকে আমি আর ফিরে পাব না।' বলতে বলতে হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি।
খুনি হাসিনার জন্য দেশের অনেক মা তার সন্তান হারিয়েছে উল্লেখ করে শহীদ শ্রাবণের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার পাশাপাশি হত্যাকারীদের বিচারের দাবি জানান তিনি।
শহীদ শ্রাবণের বড় ভাই মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পি (৩১) বাসসকে বলেন, শ্রাবণ ২০২৪ সালে এইচএসসি পাস করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকায় যান। ছয় মাস আগে পড়ালেখার পাশাপাশি রেনেটা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে যোগদান করেন। চাকুরিরত অবস্থায় ২০২৪ সালের ৩, ৪ ও ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন এবং পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
তিনি আরও বলেন, গত ৪ আগস্ট রাতে মায়ের সাথে কথা বলার পর মা আমার কাছে ফোনটা ধরিয়ে দিলে আমিও তাকে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করি। এক পর্যায়ে শ্রাবণ বলে, 'ঠিক আছে ভাইয়া; আমি আন্দোলনে যাব না। কাল আরিফ মামার বাসায় দাওয়াত খেতে যাব। কোনো আন্দোলনে যাব না।'এই হলো রাতের শেষ কথা। এরপর সে বাবাকে ফোন দেবে বলে ফোন কেটে দেয়।
শহীদ শ্রাবণের বাবা মোশারফ হোসেন (৫৭) বলেন, শ্রাবণ ৪ আগস্ট রাতে ফোন দিয়ে ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা করে। বলে, 'ভালোভাবে কাজ করো শরীরের প্রতি যত্ন নিও। খাওয়া-দাওয়া ভালো করে করো। ছোট ভাই ইখতিয়ার রহমানকে দেখে রাখো বাবা।' এই হলো বাবার সাথে তার শেষ কথা।
তিনি আরও বলেন, 'আমার ছেলের কী অপরাধ ছি? অপরাধ শুধু আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। সেটা কি অপরাধ? সে তো কোনো পুলিশকে মারেনি! আমার নিষ্পাপ নিরোপরাধ ছেলেকে কেনো গুলি করে হত্যা করা হলো।? আমি এর বিচার চাই এবং আমার ছেলেসহ সকল নিহতদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানাই।'
শহীদ শ্রাবণের বড় ভাই মোস্তাফিজুর রহমান বাপ্পি (৩১) বলেন, পরদিন ৫ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে আমি শ্রাবণকে ফোন দেই। সে বলে, 'আমি আরিফ মামার বাসায় দাওয়াত খেতে যাব। দাওয়াত খেয়ে বাসায় ফিরব।'
এরপর দুপুর ১টার দিকে শ্রাবণকে আবারও ফোন দেই। সে তখন বলে, 'দাওয়াত খেয়ে বের হয়েছি। চুল কেটে বাসায় যাব।' এই তার সাথে শেষ কথা। পরে তার সহপাঠীরা তাকে বলে, সে ৩ আগস্ট থেকেই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। ঘটনার দিনও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল।
শ্রাবণ মিরপুর ১ সেকশন ৬ রোডের মিল্কভিটা এলাকায় মেসে থাকতেন। ঘটনার দিন তিনি প্রথমে শ্রাবণ মিরপুর ১০ নম্বর থেকে মিরপুর ২ নম্বর মডেল থানার কাছে যান। সেখানে মিরপুর ২ থানার বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে পুলিশ ৭জনকে গুলি করে হত্যা করে।
এসময় শ্রাবণও ঘটনাস্থলেই গুরুত্বর আহত হন। স্থানীয়রা ডা. আজমল হসপিটালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার ডান বুকে গুলি লেগেছিল।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার দিন ৫ আগস্ট বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে শ্রাবণের ফোন থেকে ডা. আজমল হসপিটালের ম্যানেজার পরিচয়ে এক ভাই ফোন দিয়ে বলেন, 'আপনার নাম কী। আপনি শ্রাবণের কে হন?' আমার পরিচয় দেওয়ার পর উনি বলেন, 'আপনার ভাইয়ের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে আসেন। '
সাথে সাথে আমি বাবা, মা ও আমার স্ত্রীকে বিষয়টি জানাই। কিন্তু আমরা সেদিন ঢাকায় যেতে পারিনি। কারণ সব যানবাহন বন্ধ ছিল। ঢাকায় আত্মীয়-স্বজনের সাথে যোগাযোগ করে পরদিন আজমল হসপিটালে যাই এবং ৬ আগস্ট ভোর সাড়ে ৩টার দিকে তার লাশ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। বেলা ১১টার দিকে শ্রাবনকে পারিবারিক করোরস্থানে দাফন করা হয়।
প্রতিবেশী সাইদুর রহমান ও রাজু বলেন, সে খুব ভালো ছেলে ছিল। খুনি হাসিনা দেশটাকে শেষ করে দিয়েছে। শত শত শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছে এই আন্দোলনে। তাদের বিচারের দাবি করেন তারা।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বলেন, জেলার ৯জন শহীদের প্রত্যেকের নাম গেজেটভুক্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে শহীদ পরিবারগুলোকে প্রশাসন থেকে ২ লাখ টাকা করে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে শিগগির আরপ ৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র প্রদান করা হবে।