প্রতিবেদন : আব্বাছ হোসেন
লক্ষ্মীপুর, ২২ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : সবসময় বইয়ের ভেতর ডুবে থাকত কাউছার হোসেন বিজয়। পদার্থবিজ্ঞানের কঠিন সূত্র, তাপগতিবিদ্যার জটিল পাঠ, পরীক্ষার জন্য নিরলস প্রস্তুতি- এসবই ছিল তার পৃথিবী। রাজনীতি, আন্দোলন বা মিছিল-মিটিং এসব যেন তার একেবারেই বাইরের কোনো বিষয়। দেশের বাতাসে বিপ্লবের গন্ধ ছড়ালেও, সে ছিল পড়ার টেবিলে নির্বিকার, নির্লিপ্ত।
তার ঠিক বিপরীত চরিত্র ছিল ছোট ভাই কাদের আমিন বিপু। এইচএসসি পরীক্ষার্থী হয়েও বিপ্লবের ডাকে সাড়া দিতে একটাও মিছিল মিস করত না সে। বিজয় তাকে বারবার বুঝিয়ে বলত, ‘বিপু, এসব রাজনীতি আমাদের মতো সাধারণ ছাত্রদের জন্য নয়। পড়ালেখাই আসল কাজ।’ ভাইকে আন্দোলনের ঝুঁকিপূর্ণ পথ থেকে সরিয়ে রাখতে বিজয়ের সেই নিরন্তর চেষ্টা ছিল যেন এক নীরব যুদ্ধ।
কিন্তু ইতিহাস মাঝে মাঝে এমন এক মুহূর্ত নিয়ে আসে, যা সবকিছু পাল্টে দেয়। বিজয়ের জীবনে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট, এক শান্ত সকালে। পড়ার টেবিলে বসে টিভিতে আন্দোলনের খবর দেখছিল সে। হঠাৎই স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুলের মুখ। জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখছেন তিনি।
তার প্রতিটি শব্দ যেন ছুরি হয়ে বিঁধে যায় বিজয়ের হৃদয়ে। প্রতিবাদের আগুনে ধূসর হয়ে যায় তার নির্লিপ্ততা। সে যেন এক নতুন দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে দেশকে-জগৎকে- স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু, নিপীড়নের করাল থাবা, বৈষম্যের নির্মম বাস্তবতা।
ড. আসিফ নজরুলের ভাষণে বিজয় উপলব্ধি করে- শুধু রাজনীতিবিদ নয়, প্রতিবাদ করতে হবে ছাত্রদেরকেও। সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ। এক রাতেই বদলে যায় তার পরিচয়- সে হয়ে ওঠে রাজপথের এক লড়াকু সৈনিক। ছোট ভাই বিপুকে নিয়ে ছুটে যায় লক্ষ্মীপুরের আন্দোলনে, অংশ নেয় স্বৈরাচার পতনের দাবিতে বিক্ষোভে। মায়ের কান্না, বাবার অনুরোধ- কিছুই থামাতে পারেনি তাকে।
আর সেই দিইন- ৪ আগস্ট, বিজয় গুলিবিদ্ধ হয়। রাজপথেই পড়ে থাকে তার নিথর দেহ। স্বৈরাচারের বুলেট থামিয়ে দেয় তার হৃদস্পন্দন, কিন্তু থামাতে পারেনি তার বিবেকের জাগরণ। তার রক্তে লেখা হয় এক ছাত্রের আত্মত্যাগের গল্প- যা ইতিহাসে থেকে যাবে অমর হয়ে।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সংবাদদাতা সম্প্রতি কথা বলেন বিজয়ের শোকস্তব্ধ মা জোছনা আক্তার ও বাবা ইছমাইল হোসেনের সঙ্গে। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় না আর কোনো শব্দ, শুধু চোখের জলেই যেন লেখা থাকে এক সন্তানের অপূরণীয় শোকগাথা। তারা বলেন, ‘বিজয় কখনও রাজনীতির ধারেকাছেও যেত না। শুধু বই আর কলম ছিল তার সঙ্গী। আমরা ভাবতাম, ও-ই একদিন হবে আমাদের ঘরের আলোর দিশা হবে। কে জানত, সেই বিজয় হবে রক্তে লেখা এক ইতিহাসের নাম!’
বিজয়ের আত্মদান শুধু তার পরিবারের নয়, পুরো জাতির জন্যই এক উদ্দীপনার প্রতীক। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে াড়ানো একজন ছাত্রের অগ্নিসংকল্পের প্রদীপ্ত নিদর্শন। বিজয় আজ বেঁচে নেই, কিন্তু তার বিবেকের জাগরণ, তার আত্মদানের অনন্য কাহিনি এ দেশের ইতিহাসে চিরকাল বেঁচে থাকবে, রক্তে লেখা এক আত্মদানের গল্প হয়ে।
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট। বেলা ১১টা। সারাদেশের মতো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে উত্তাল ছিল পুরো লক্ষ্মীপুর। মিছিলে-মিছিলে মুখরিত ছিল পুরো শহর। হঠাৎ আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা উত্তর তেমুহনী থেকে একটি মিছিল নিয়ে ঝুমুর চত্বরের দিকে যাচ্ছিল। এসময় আন্দোলনকারীদের মিছিলের ওপর হামলা চালানো হয়। পাল্টা প্রতিরোধের চেষ্টা করে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরা।
এসময় জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের অপসারিত চেয়ারম্যান একেএম সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে মুহুর্মুহু গুলি ছোড়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এর জেরে ফুঁসে ওঠে শিক্ষার্থীরা। মিছিল নিয়ে বাজারের দিকে এগোতে থাকে তারা।
শহরের তমিজ মার্কেট এলাকায় পৌঁছলে নিজ বাসভবনের ছাদ থেকে প্রকাশ্যে সালাউদ্দিন টিপু ও তার সহযোগীরা শিক্ষার্থীদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে কাউছার হোসেন বিজয় এবং এইচএসসি পরীক্ষার্থী সাদ আল আফনান, তৌহিদ কবির রাফি ও সাব্বির হোসেন শহীদ হন।
এসময় তিন শতাধিক গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় কমপক্ষে ৫০০ শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় একাধিক হত্যা মামলায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের কয়েক হাজার জনকে আসামি করে মামলা হয়।
শহীদ বিজয়ের মা বিলাপ করে বলেন, ‘বিজয় আমাকে বলে মা তুমি কোনো চিন্তা করো না। মিছিল শেষ করে আবার ফিরে আসবো। এইটুকু বলে বিজয় মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়। কিন্তু বিজয় ওইদিন রাতে জীবিত নয়, বুকের দুই পাশে গুলিবিদ্ধ লাশ হয়েই মায়ের কাছে ফিরে আসে।
স্বপ্ন ছিল ছেলে পড়ালেখা শেষে বড় কর্মকর্তা হয়ে দেশের জন্য কাজ করার। কিন্তু সেই স্বপ্ন থেকেই গেল।’ আহাজারি করে কথাগুলো বলছিলেন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর এলাকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুবলীগের গুলিতে নিহত কাউছার হোসেন বিজয় (২৩)-এর মা জোছনা আক্তার ও বাবা ইছমাইল হোসেন।
কান্নাজড়ানো কন্ঠে বিজয়ের মা আক্ষেপ করে বলেন, তাদের নিজের কোনো ঘর বা সহায়-সম্পত্তি নেই। নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে অন্যের ঘরে বসবাস করেন তারা। স্বপ্ন ছিল দুই ছেলে পড়ালেখা করে অনেক বড় কর্মকর্তা হবে। বাবা-মার দুঃখ-কষ্ট লাঘব করবে। তাদের অভাব-অনটন দূর হবে। কিন্তু বিজয়ের মৃত্যুতে সেসব আশা চুরমার হয়ে গেছে।
এখন কী নিয়ে বাঁচবেন, কী করে সামনের দিনগুলো যাবে- সে চিন্তাই প্রতিনিয়ত মাথায় ঘুরপাক খায় বিজয়ের মা-বাবার। মনে হয়, এই তো বিজয় ঘরে আসছে। এই নিয়ে রাত-দিন কাটছে তাদের।
এদিকে বিজয়ের বাবা ইছমাইল হোসেন বলেন, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ ও সরকারিভাবে ৫ লাখ টাকার আর্থিক অনুদান পেয়েছি। এর বাইরে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আরো কিছু সহযোগিতা পাই। তবে ছেলেকে হারিয়েছি, কষ্ট থাকলেও দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে অনেক তাজা রক্তের বিনিময়ে। শহীদরা ও আহতরা যেন সে সম্মান ও মর্যাদা পায়, সেটাই আশা করেন তিনি।
কথা হয়, প্রতিবেশী ও সংবাদকর্মী মো. রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, লক্ষ্মীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মেধাবী শিক্ষার্থী কাউছার হোসেন বিজয়সহ শহীদ হন ১৬ জন। এদের মধ্যে চার আগস্ট বিকেলে সাবেক যুবলীগের আহ্বায়ক একেএম সালাউদ্দিন টিপুর গুলিতে নিহত হয় চারজন। অন্য ১২ জন ঢাকায় শহীদ হন।
উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও ঢাকা উত্তরের জামায়াতের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিম বলেন, কাউছার হোসেন বিজয় মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। তার মতো নম্রভদ্র ছেলে এই সমাজে খুঁজেও পাওয়া যাবে না। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে নিজের তাজা প্রাণ দিয়ে দিলেন।
কুখ্যাত খুনি সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে যুবলীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হন বিজয়। জড়িতদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি। যারা এই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন বা আহত হয়েছেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী প্রত্যেক পরিবারের পাশে থাকবে, সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
পুলিশ সুপার মো. আকতার হোসেন বলেন, কাউছার হোসেন বিজয়, সাদ আল আফনান, সাব্বির ও তৌহিদ কবির রাফিসহ চারজন জেলায় ও ১২ জন ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। যাদের গুলিতে এই ১৬ জন মারা যান, প্রত্যেক আসামিকে আইনের আওতায় আনা হবে।
ইতোমধ্যে লক্ষ্মীপুরে ৪ শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় প্রায় ৮৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেফতারের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক রাজিব কুমার সরকার বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের অনেকেরই বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। জেলা প্রশাসন প্রত্যেক পরিবারের পাশে রয়েছে। এখন পর্যন্ত জেলায় ৪ জনসহ জেলার ১৬ জন বাসিন্দা শহীদ ও ২৫৯ জন আহতের তালিকা করা হয়েছে। প্রশাসন সবসময় তাদের পাশে রয়েছে।
এদিকে লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনে যারা শহীদ হয়েছেন বা আহত হয়েছেন, বিএনপি তাদের পাশে রয়েছে। কোনো হত্যাকারী ছাড় পাবে না। প্রত্যেকের বিচার হবে।