‘আমার ছেলে কবরে আর খুনিরা সব মুক্ত বাতাসে’ : শহীদ তারিকের মায়ের আক্ষেপ

বাসস
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ২১:৫৩ আপডেট: : ২২ জুন ২০২৫, ২৩:০৭
শহীদ তারিক হোসেন -ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : মো. শরিফুল ইসলাম

চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ২২ জুন, ২০২৫ (বাসস) : ‘আমি একজন ছেলেহারা মা। পৃথিবীতে সন্তান হারানোর বেদনা যে কত কষ্টের যারা সন্তান হারিয়েছেন সেই মায়েরাই শুধু জানেন। আমার ছেলে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিজয় মিছিলে যোগ দিয়ে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে শহীদ হয়েছে। দেশের জন্য আমার ছেলে জীবন দিয়েছে।’ কথাগুলো বলতে বলতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না শহিদ তারিক হোসেনের মা ফিরদিসি বেগম।

আক্ষেপ করে ফিরদিসি বেগম বলেন, ‘যারা আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করল তারা আজ মুক্ত বাতাসে আরাম-আয়েশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমি, আমার স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বুকভরা কষ্ট নিয়ে দিন পার করছি।’ 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার চৌডালা ইউনিয়নের দক্ষিণ এসলামপুর গ্রামের শহীদ তারিকের মা ফিরদিসি বেগম (৪০) বলেন, ‘গত ১৮ বছর আগে আমার কোলে আসে আমার দ্বিতীয় সন্তান তারিক। আমাদের সংসারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল। কিন্তু আমার সংসারে যে এত বড় একটি ঘটনা ঘটে যাবে তা কোনদিনই ভাবিনি।’ 

তিনি বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরা তারিক বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ওই দিন বিকেলে গণভবনের দিক থেকে বিজয় মিছিল করতে করতে ঢাকা আগারগাঁও চৌরাস্তা মোড়ে আসলে অতর্কিতভাবে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি বর্ষণ শুরু হয়। এসময় মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়।’

‘এর মধ্যে আমার সন্তান তারিকও গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুত্বর আহত হয়। আন্দোলনের সহযোগীরা ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করে। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে আইসিইউ বিভাগে স্থানান্তরিত করা হয়। খবর পেয়ে আমরা পরিবারের সবাই হাসপাতালে ছুটে যাই।’

শহিদ তারিকের বাবা আসাদুল হক (৪৫)-এর সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, কথা বলে কী লাভ হবে? আপনারা কি আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন? নানাভাবে বুঝানোর চেষ্টর তিনি একসময় তার প্রিয় সন্তান তারিকের বিষয়ে একটু একটু বলতে শুরু করেন। 

তিনি বলেন, তারিকের পেটে চারটি এবং হাতে একটি গুলি বিদ্ধ হওয়ার ফলে কথা বলতে পারছিল না। তাকে হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এই অবস্থা দেখে আমরা বাড়ির সবাই হাসপাতালের বাইরে অঝোরে কাঁদতে থাকি আর তারিকের জন্য দোয়া কেিত থাকি।

ওই সময় হাসপাতালে এত আহত রোগী ছিল যে কেউ কারো খোঁজ নেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। হাসপাতালের মেঝেতে স্তূপ করে রাখা লাশ আর লাশ। নিহতদের স্বজনেরা তাদের লাশের খোঁজে হাসপাতালে ছোটাছুটি করছে। কেউ কারো কথা শুনছে না। যে যার মতো কান্না-কাটি করছে। তাদের আহাজারিতে হাসপাতালের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে গেছে। লাশের গন্ধে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ।  

৫ আগস্ট বিকেল থেকে ৯ আগস্ট শুক্রবার জুমার নামাজের পর একজন নার্স এসে বলেন, তারিকের আপনজন কে আছেন? জবাবে আমি বললাম জি আমি তারিকের বাবা। নার্স আমার দিক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, একটি খারাপ সংবাদ আছে। তার কথা শুনে আমার আর বোঝার বাকি রইল না যে, ‘আমার কলিজার টুকরা তারিক আর বেঁছে নেই।’ 

তিনি বলেন, হাসপাতাল সূত্রে জানতে পারি তারিকের জখম খুবই গুরুতর ছিল। তার শরীর থেকে অনেক রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। তাছাড়া তারিক মুখ দিয়ে কিছুই খেতে পারছিল না। ফলে তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের আনুষ্ঠানিকতা শেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের ৯ আগস্ট বিকেল ৫ টায় লাশ বুঝিয়ে দেয়। অ্যাম্বুলেন্স ঢাকা থেকে লাশ গ্রামে নিয়ে যাই। ১০ আগস্ট বেলা ১১টায় জানাজা শেষে চৌডালা দক্ষিণ এসলামপুর কবরস্থানে তারিককে দাফন করি।’

তিনি আরও বলেন, এর মাঝে আমি সহযোগিতা হিসেবে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলমের হাত থেকে ৫ লাখ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) এর হাতে ২ লাখ এবং জামায়াতের পক্ষ থেকে ২ লক্ষ টাকা পেয়েছি।   

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সামাদ বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের তালিকাভুক্ত ২ জন শহীদের মধ্যে মো. তারিকের নাম রয়েছে। তাদের প্রতি জেলা প্রশাসকের সব ধরনের সহযোগিতার থাকবে। এর মধ্যে তারিকের বাবার হাতে ২ লাখ টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। 

শহিদ তারিকের বড় ভাই আসমাউল হুসনা বলেন, আমার ভাই দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু প্রিয়জন হারানোর শোকে আমাদের চোখে চিরদিন অশ্রধারা বইতে থাকবে ।

তারিকের ছোট বোন আসরিফা বলেন, আমার ভাই তারিক হোসেন দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। যারা আমার ভাইয়ের জীবন নিল আমরা তাদের বিচার চাই। খুনিরা আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সরকারের কাছে আমাদের একটাই চাওয়া- জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার যেন দেশের মানুষ দেখতে পায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়াকে 
সচিবালয়ে ভাঙচুর-হত্যাচেষ্টা মামলার প্রতিবেদন ২৮ আগস্ট
ইসির আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও বিদেশি গণমাধ্যম নীতিমালা-২০২৫ জারি
ছিনতাইয়ের প্রস্তুতিকালে দেশীয় অস্ত্রসহ এক ছিনতাইকারী গ্রেফতার
গভীর রাতে এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা 
সাঁথিয়া পৌরসভার সাবেক মেয়র গ্রেফতার 
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সাথে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ
মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পের কেন্দ্র পরিদর্শনে যাবেন ইফার গর্ভনরেরা
গুলিস্তানে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের দুই কর্মী ককটেলসহ গ্রেফতার
পুলিশের বিশেষ অভিযানে সারাদেশে গ্রেফতার ১,৭৫৪ জন
১০