চট্টগ্রাম, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : ঢাকার মাঠে পায়ের কারুকাজ দিয়ে নিজের সক্ষমতার প্রমান দিয়ে চলেছেন ২৭ বছর বয়সী ফুটবলার নিক্সন চাকমা। নিক্সন রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার এক দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে উঠে আসা ফুটবলার।
পাহাড়ি অঞ্চলের অবহেলিত পরিবেশ, সীমিত সুযোগ-সুবিধা আর আর্থিক সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল ছিন্ন করে তিনি এখন সারাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। আর্থিক অস্বচ্ছলতা, পর্যাপ্ত অনুশীলনের অভাব এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা উপেক্ষা করে এই তরুণ ফুটবলার এখন ঢাকার বিভিন্ন ফুটবল লীগে নিজের প্রতিভার প্রমাণ দিচ্ছেন। দূর্দান্ত প্রতিভা এবং ক্রীড়াশৈলীর মাধ্যমে ঢাকার মাঠে তুলে ধরছেন চট্টগ্রামের মাঠ থেকে উঠে আসা এই ফুটবলার।
জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করা বাবা মোহন লাল চাকমা এবং গৃহিনী সোনাবি চাকমার ২ ছেলে এবং ১ মেয়ের মধ্যে সবার ছোট নিক্সন। ছোটবেলা থেকে ফুটবলের প্রতি বিশেষ টান এবং পরিবারের অভাব অনটনের কারণে পড়ালেখা শেষ করার ইচ্ছা থাকলেও কলেজের গন্ডি পেরিয়ে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়ে আর শেষ করা হয়নি।
নিক্সনের শৈশব কেটেছে রাঙ্গামাটির দূর্গম পাহাড়ি পল্লীতে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ কিংবা উন্নত খেলার সামগ্রী তো দুরের কথা, বল জোগাড় করাই ছিল চ্যালেঞ্জ। গ্রামের পাহাড়ি মাঠে কখনও বাতিল করা বল, কখনও অন্য কারো বল ধার নিয়েই চলেছে তার প্রাথমিক ফুটবল অনুশীলন। পাহাড়ি জীবনযাপনের নানা সংকটের পাশাপাশি নিক্সনকে পোহাতে হয়েছে পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েন। জুম কৃষক বাবার সামান্য আয়ে সংসার চললেও ছেলের ফুটবল খেলার স্বপ্নটা অনেক সময়ই ছিল বিলাসিতা। তবুও হার মানেননি নিক্সন। এভাবে মনের অভিব্যক্তিগুলো বাসস এর কাছে প্রকাশ করলেন পাহাড় থেকে ওঠে আসা ফুটবলার নিক্সন চাকমা।
ফুটবলের শুরু কিভাবে হয়েছিল সে সম্পর্কে নিক্সন বলেন, স্থানীয় নানা প্রতিযোগিতায় তার খেলার দক্ষতা দেখে গ্রামের বড় ভাইদের পরামর্শে ২০১৬ সালে প্রথম ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করেন রাঙ্গামাটি জেলা ফুটবল স্টেডিয়ামে। সেখানে প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে ধীরে ধীরে নজরে পড়েন রাঙ্গামাটি জেলা ক্রীড়া সংস্থার। সুযোগ পান রাঙ্গামাটি জেলা ফুটবল দলে। এক সময় আর্থিক সমস্যার কারণে ফুটবলে নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে বাধার সৃষ্টি হয়, পরিবারের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছিলেন না। তখন ফুটবল ছেড়ে দেবার কথা মাথায় আসে। কিন্তু কঠিন সময়ে ফুটবলের প্রতি অগাধ ভালবাসা এবং দৃঢ়তার জোরে বাঁধা বিপত্তি দূর করে চালিয়ে গেছেন ফুটবল। তার ইচ্ছা ছিল একদিন প্রান্তিক অঞ্চল থেকে উঠে এসে ঢাকার মাঠে নিজেকে তুলে ধরবেন। সেই লক্ষ্যে ২০১৭ সালে চলে আসেন চট্টগ্রামে।
নিক্সন জানান, অভাব-অনটনের মাঝে ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম জেলা দলের হয়ে অংশ নেন বিভাগীয় পর্যায়ের নানা প্রতিযোগিতায়। সেখানে তিনি সক্ষমতার পরিচয় দেন। জেলা পর্যায়ে তার দক্ষতা টিম ম্যানেজমেন্টের চোখে পড়ে। অসধারণ বল দখলের দক্ষতা, দৃঢ়তা, বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক সক্ষমতা দিয়ে সেন্টার ব্যাক পজিশনে খেলা এই প্রতিভাবান ডিফেন্ডার নৈপূর্ণ্য প্রদর্শন করে নজর কাড়েন সবার। পরিচিত হতে থাকে চট্টগ্রামে লীগ মাতানো বড় মাপের ফুটবলারদের সাথে। সেই থেকে তার আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। নৈপূণ্য এবং দক্ষতার সাথে তার ঝুলিতে আসতে থাকে সাফল্য। সেই সুবাদে ২০১৮ সালে প্রথমবারের মত ঢাকায় খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন বলে জানান নিক্সন।
২০১৮ সালে ঢাকায় ২য় বিভাগের দল বিজি প্রেসের হয়ে খেলার সুযোগ হয় তার। সুযোগটি কাজে লাগান নিজের নৈপূণ্য এবং দক্ষতা দিয়ে। প্রতিপক্ষকে রুখে দেওয়ার সক্ষমতা এবং নৈপূণ্য প্রদর্শন করে চোখে পড়েন ঢাকা যাত্রাবাড়ী ক্রীড়া চক্রের। ২০১৯ মৌসুমে চুক্তিবদ্ধ হন যাত্রাবাড়ী ক্রীড়া চক্রে। যাত্রাবাড়ীর হয়ে ১ম ডিভিশন ফুটবল লীগে সেন্টার ব্যাক পজিশনে মাঠ মাতান তিনি। যাত্রাবাড়ীতে খেলার সময় বিসিএল এর দল নোফেল স্পোর্টিং ক্লাব এর নজড়ে পড়েন নিক্সন। ২০২১-২২ মৌসুম সফলতার সাথে শেষ করেন নোফেল স্পোর্টিং ক্লাবে। পরের বছর ২০২২-২৩ মৌসুমে জায়গা করে নেন ঢাকার অন্যতম ক্লাব মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রে। পুরো মৌসুমে তিনি অসধারণ নৈপূর্ণ্য প্রদর্শন করেন। এর আগে তিনি কিছুদিন চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার ফুটবল লীগের কোয়ালিটি স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন। ২০২৩-২৪ মৌসুমে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশীপ লীগ এ খেলেন ঢাকার ফুটবলের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী দল আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের হয়ে। আরামবাগের হয়ে ৪ নাম্বার জার্সি গায়ে সেন্টার ব্যাক পজিশনের গুরু দায়িত্ব সামলেছেন নিক্সন।
এই ফুটবলার জানান, সেন্টার ব্যাক পজিশনে খেললেও তার প্রিয় খেলোয়াড় হচ্ছে বিশ্ব ফুটবলের সুপারস্টার পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। তার ক্ষিপ্রতা এবং গতি সবসময় নিক্সনকে অনুপ্রাণিত করে।
নিক্সন চাকমা বলেন, ফুটবল যাত্রার শুরু থেকে শত বাঁধা বিপত্তির পরেও এই পর্যন্ত আসা একমাত্র কঠোর পরিশ্রম এবং দৃঢ়তার কারণে সম্ভব হয়েছে। শত বিপত্তির পরেও ফুটবল ছেড়ে দেইনি। চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় শুরুতে অনেক প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হতে হয়। আমি সবসময় চেষ্টা করি প্রতিটি বলের জন্য লড়াই করতে। প্রতিপক্ষকে গোল করতে না দেওয়া, দলকে নিরাপদ রাখা আমার মূল দায়িত্ব। দক্ষতা এবং নৈপূণ্য প্রদর্শন করে এ পর্যায়ে এসেছি। আমি চাই, আমার মতো পাহাড়ি প্রান্তিক এলাকার আরও অনেক ছেলেমেয়ে ফুটবলে নিজের জায়গা তৈরি করুক। সরকার এবং বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থা যদি একটু নজর দেয়, তাহলে পাহাড় থেকেও অনেক প্রতিভা উঠে আসবে বলে আশা তার।
খেলার প্রতি দৃঢ়তা এবং আগ্রহ সম্পর্কে বলতে গিয়ে সতীর্থ আরামবাগের ফুটবলার রুবায়েদ বলেন, ফুটবলের প্রতি দৃঢ়তা এবং আগ্রহ নিক্সনকে আজ ঢাকার মাঠে পরিচিত করে তুলেছে। তার খেলায় চোখে পড়ে অসাধারণ পজিশনিং সেন্স। প্রতিপক্ষের লম্বা বল বা কর্নার থেকে আক্রমণ সহজে ভাঙতে তিনি সিদ্ধহস্ত। বর্তমানে তিনি আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের সেন্টার ব্যাক পজিশনের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
তিনি জানান, শারীরিকভাবে ফিট নিক্সন প্রতিটি ম্যাচে ৯০ মিনিট টানা লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন। দেহের ভারসাম্য, গতির সঙ্গে তাল মেলানোর ক্ষমতা এবং বল কন্ট্রোল তাকে আরও কার্যকর সেন্টার ব্যাক হিসেবে গড়ে তুলেছে। যা তাকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করে তুলেছে।
এই ফুটবলার স্বপ্ন দেখেন একদিন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলার। যোগ্যতা এবং প্রতিভা দিয়ে নিজেকে তুলে ধরতে চান মাঠে। নিজেকে প্রমাণ করতে চান দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে।