
বান্দরবান, ১ নভেম্বর ২০২৫ (বাসস) : বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের উইঙ্গার জাফর ইকবাল বলেন, একজন ফুটবলারের নিজেকে একজন সফল খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কঠোর পরিশ্রম এবং নিষ্ঠার পাশাপাশি অদম্য ইচ্ছাশক্তিরও প্রয়োজন।
পার্বত্য জেলা বান্দরবানের বাসিন্দা জাফর বাসসকে বলেন, ‘শুধুমাত্র কঠোর পরিশ্রমই যথেষ্ট নয়। একজন ফুটবলারকে মাঠে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করতে হবে এবং সাফল্য অর্জনের জন্য মনোযোগী থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ফুটবল ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে স্থানীয় খেলোয়াড়দের মান উল্লখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের স্থানীয় খেলোয়াড়রা এখন দেশীয় লীগে বিদেশী খেলোয়াড়দের পাশাপাশি সমানভাবে ভালো পারফর্ম করছে।’
জাতীয় দলের ফুটবলার জাফর বলেন, সাঙ্গু নদীর পাড়েই আমার বেড়ে উঠা। জেলা সদরের বোডঘাটার পাশে তখন আমাদের বাসা ছিল। নদীর পারেই সিনিয়র ভাইরা খালি পায়ে খেলত। ওরা কিভাবে খেলত সেটা দেখতাম। নিজেও ওইরকম খেলার চেষ্টা করতাম। ওই সময় থেকেই ফুটবলের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মায়। আমার বয়স যখন ৮-১০ বছর তখনই বান্দরবান স্টেডিয়ামে খেলতে আসি। তখন বড় ভাইরা বুট পড়ে স্টেডিয়ামে খেলত। আমার চোখ তখন তাদের বুটের দিকে। তাদের দেখে মাঠের এক পাশ দিয়ে খেলতাম। একদিন এক বড় ভাই আমার খেলা দেখে বলল তুমি তো ভালো খেলো। বুট নিয়ে আসো, তখন আমাদের সাথে খেলতে পারবা । আর তখন থেকেই সিনিয়র ভাইদের সাথে আমার খেলা।
পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সন্তান জাফরের জন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা আলী হোসাইন, মা দেলো আরা বেগম। চার ভাই বোনের মধ্যে জাফর সবার বড়। খেলাধুলার পাশাপাশি ভর্তি হয়েছিলেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে খেলাকে পেশা হিসেবে নেওয়ায় ১ম সেমিস্টারেই বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদায় জানান। তার শৈশব কেটেছে আঁকা বাঁকা পাহাড়ি নদী সাঙ্গুর তীরে।
শৈশবের স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে জাফর বলেন, জীবনের পথ চলাটা তেমন একটা সহজ ছিল না। ফুটবল খেলতে গিয়ে পরিবার থেকে আমি কোন সহযোগিতা পায়নি। বাবা-মা সবসময় আমার থেকে ভালো কিছু চাইত। খেলাধূলার প্রতি তাদের তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। বাবা চাইত মুদির দোকানের ব্যবসা সামলাই। কিন্তু আমার ব্যবসার প্রতি কোন ঝোঁক ছিল না। স্বপ্ন ছিল বড় ফুটবল খেলোয়াড় হবো। তাই সবসময় ফুটবলারদের চলাফেরা আর ফুটবল প্র্যাকটিস দেখতাম, তাদের অনুকরণ করতাম। কখনো কোন প্রাতিষ্ঠানিক কোচিং করতে পারিনি। বড় ভাইদের সাথে অনুশীলন করে করেই আমি শিখেছি। এখনো শিখছি।
এভাবেই এগিয়ে যেতে যেতে একদিন ডাক আসে বান্দরবার জেলা অনূর্ধ্ব-১৪ দলে। বান্দরবান ছেড়ে যেতে হয় রাঙামাটি স্টেডিয়ামে। হাজারো দর্শক গ্যালারিতে। চারিদিকে উৎসবের উল্লাস । দর্শকদের উচ্ছাসের সাথে ভেসে গিয়ে খেলাটা হয়ে যায় নেশা, পরে হয় পেশা।
ক্যারিয়ারের শুরুতে স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে জাফর বলেন, আমার প্রথম খেলা অনূর্ধ্ব-১৪ দলের হয়ে রাঙামাটি স্টেডিয়ামে। ২০১৩ কিংবা ২০১৪ সালে ওই খেলা হয়েছিল। এখন সালটা তেমন মনে নেই । ঐ দলের অধিনায়ক ছিলাম। আমাদের বান্দরবান টিম ওই আসরে রানার্স-আপ হয়েছিল। এরপরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পার্বত্য জেলা বান্দরবান থেকে তৃতীয় বিভাগের ক্লাব দিলকুশায় খেলার প্রস্তাব পাই। সেবার আমি সেরা খেলোয়াড় মনোনীত হয়েছিলাম। দিলকুশা ক্লাব তখন চ্যাম্পিয়ন হয়। পুরো টুর্নামেন্টের সেরা গোলদাতাও হই। সেখান থেকে ঢাকার আরামবাগ ক্লাব বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে (বিপিএল) খেলার জন্য আমাকে তাদের দলে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। প্রিমিয়ার লীগ খেলার সময় ফেডারেশন কাপে আমরা রানার্স-আপ হই। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৫-১৬ সালে জাতীয় দলের ডাক আসে। আমার ইচ্ছে ছিল জাতীয় দলে খেলব। পারফরমেন্সও ভালো ছিল। আরামবাগের হয়ে আমি ৬ গোল করছিলাম। প্রিমিয়ার লীগে তখন ১৪টি টিম ছিল। লীগের টেবিলের ছয় নম্বরে আরামবাগের অবস্থান ছিল।
মাঠ দাপানো আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড় জীবনের স্মরণীয় ঘটনার কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘আমার একটা কথা খুব মনে পড়ে। ২০১৭ সালের সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্টে ভারতের বিপক্ষে হাফটাইমে বাংলাদেশ ৩-০ গোলে পিছিয়ে ছিল। দ্বিতীয়ার্ধে আমরা চার গোল দিয়েছিলাম, যার মধ্যে ২টি গোল ছিল আমার। ঐ ম্যাচটা এখনো পর্যন্ত আমার ক্যারিয়ারের স্মরণীয় ম্যাচ। নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা সহ অনেক দেশ ওই খেলায় অংশ নিয়েছিল। তবে আমরা রানার্স আপ হয়েছিলাম। পয়েন্ট সমান থাকলেও হেড টু হেড হিসেবে বাংলাদেশ রানার্স-আপ হয়েছিল। এই টুর্নামেন্টে আমি ৫ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জয় করেছিলাম।
২০১৭ সালে বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস এসোসিয়েশন (বিএসপিএ)’র বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছিলেন জাফর ইকবাল।
জয়-পরাজয় খেলারই একটি অংশ। এ সম্পর্কে জাফর বলেন, জীবনে অনেক খারাপ সময় গেছে। তবে ফুটবলে হারজিত থাকেই। মেনে নিতে হয়। মন খারাপ নয়, কিন্তু হার থেকে শিখতে হয়। সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সামনের টুর্নামেন্টগুলো জিততে হয়। পেশাদার খেলোয়াড়দের ভালো খারাপ সময় থাকবেই। খেলার হার থেকে আমি অনেক কিছু শিখি। কোথায় ভুল ছিল সেগুলো সংশোধন করার চেষ্টা করি। কীভাবে খারাপ সময়কে ওভারটেক করে ভালো সময় আনা যায় সেটা চিন্তা করি। তবে ম্যাচ হারার পরে খারাপ লাগে।
তরুণদের উদ্দেশ্যে জাফর বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দলীয় শৃঙ্খলা। নিজের ইচ্ছাশক্তি থাকতে হবে। খেলার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, মাঠে সময় দিতে হবে।
নিজ এলাকা সম্পর্কে তিনি বলেন, বান্দরবানে নতুন খেলোয়াড়দের জন্য নিজেকে পরিনত করা অনেক কঠিন। এখানে কোন একাডেমি নেই। পর্যাপ্ত মাঠও নেই। সুযোগ সুবিধাও নেই। একাডেমি, মাঠ, আর খেলার সুযোগ করে দিলেই নতুন খেলোয়াড় তৈরি হতো। দেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য এখান থেকে অনেক খেলোয়াড় জাতীয় দলে সুযোগ পেত। অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় আছে। সুযোগ এবং সুবিধা না পাওয়ার কারণে তারা হারিয়ে যাচ্ছে। ভালো পর্যায়ে যদি ওদের সুযোগ করে দেওয়া যায় তাহলে তারা দেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
পর্তুগীজ সুপারস্টার ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর খেলার জাফর অনুসরণ করেন। বাংলাদেশের পরে পছন্দের দল ব্রাজিল।
ফিটনেস ও পারফরমেন্স যতদিন থাকবে ততদিন খেলা চালিয়ে যেতে চান জাফর। এরপর অবসরের বিষয় চিন্তা করবেন। আর অবসরের পর কোচিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান।
ছেলের সাফল্যে গর্বিত বাবা আলী হোসাইন বলেন, ‘আমার ছেলে জাতীয় দলের খেলোয়াড় । তাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। ছোটবেলা থেকেই তার ফুটবলের প্রতি ঝোঁক ছিল, পরিশ্রমও করত। কোন ম্যাচ জিতে ঘরে আসলেই পরিবারের সবাই খুশি হতো। এলাকার মানুষও তাকে খুব পছন্দ করে।’