
ঢাকা, ৭ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : অপেক্ষার পর্ব শেষে শনিবার পর্দা উঠছে তীর এশিয়ান আরচ্যারী চ্যাম্পিয়নশিপস ২০২৫ এর। কদিন ধরে টঙ্গী ও জাতীয় স্টেডিয়ামের আঙিনা মুখরিত ছিল এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা আরচ্যারদের অনুশীলনে। শনিবার শুরু হবে তীর-ধনুকের আসল লড়াই।
রিকার্ভ ও কম্পাউন্ড মিলিয়ে ১০ ইভেন্টের পদকের লড়াইয়ে ৩০টি দেশের মোট ২০৯ জন আরচ্যার অংশ নিচ্ছে এবার। উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক নারী আরচ্যারও অংশ নিচ্ছে, রিকার্ভে ৫৪ জন এবং কম্পাউন্ডে ৩৮ জন মিলিয়ে মোট ৯২ জন। এছাড়া ৮০ জন অফিসিয়াল ও ১৭ জন অতিথিও অংশ হচ্ছেন এশিয়ান আরচ্যারীর সর্বোচ্চ আসরের এবারের আয়োজনে। ৮ নভেম্বর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে শেষ হবে ১৪ নভেম্বর। জাতীয় স্টেডিয়াম ও আর্মি স্টেডিয়াম-এই দুই ভেন্যুতে হবে প্রতিযোগিতা।
আয়োজক হতে অবশ্য বাংলাদেশকে পোড়াতে হয়েছিল অনেক কাঠখড়। ভারত ও চীন ছিল আয়োজক সত্ত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী। ভারত ‘ছাড়’ দিলে চীন ছিল লড়াইয়ে। ভোটাভুটিতে ১৪-১০ ব্যবধানে জিতে ২০১৭ ও ২০২১ সালের পর তৃতীয়বারের মতো এই আসরের আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশের নাম ঘোষিত হয়।
সেই থেকে শুরু হয় বাংলাদেশ আরচ্যারী ফেডারেশনের নতুন চ্যালেঞ্জও। বিভিন্ন দেশের আরচ্যার, কর্মকর্তাদের ঢাকায় আনা, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকার ব্যবস্থা করা, প্রস্তুতির ভেন্যু নির্ধারণ, আরচ্যারদের যাতায়াত ব্যবস্থা করাসহ নানা চ্যালেঞ্জ দাঁড়ায় ফেডারেশনের সামনে। সরকারের সহযোগিতা, সিটি গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় বাধাগুলো উৎরে যায় আরচ্যারী ফেডারেশন।
চ্যালেঞ্জ ছিল আরও। বিশেষ করে নানা সংঘাতে বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেনের মতো দেশগুলোর আরচ্যারদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হয়। ফিলিস্তিন থেকে অংশ নিচ্ছেন চার জন আরচ্যার। দলের একমাত্র নারী আরচ্যার রাশা ইয়াহিয়া আহমেদ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত গাজা থেকে উঠে আসা রাফা বর্তমানে লেখাপড়া করছেন ওমানের মাসকটের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, চাকুরি করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। তিন বছর আগে তীর-ধনুক হাতে তুলে নেওয়া এই আরচ্যার বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসায়, আরচ্যারী ফেডারেশনের আয়োজনে মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন।
“এই প্রথম বাংলাদেশে এসেছি এবং বিমানবন্দর থেকে শুরু করে এখানকার সবাই ভীষণ আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের স্বাগত জানিয়েছে। এমনকি বিমানবন্দর থেকে হোটেলে আসা পর্যন্ত সবাই ছিল ভীষণ আন্তরিক। আমাদের সবাই খুশি এবং সবাই আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে, সহযোগিতা করছে।”
“একটা বিষয় না বললেই নয়, একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে আমরা জানি এবং অনুভব করি বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন। যখন এখানে এসেছি, আমি অনুভব করতে পারছি, সবাই আমাদেরকে নিজেদের করে নিয়েছে। বাংলাদেশের আয়োজনও বিশ্বমানের, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে এখানকার আয়োজনের কোনো পার্থক্য আমার চোখে পড়ছে না।”
বাংলাদেশের আরচ্যারীপ্রেমীদের চোখ অবশ্য থাকবে নিজেদের তারকা আব্দুর রহমান আলিফ, সাগর ইসলাম, বন্যা আক্তারদের দিকে। ২০২১ সালের আসরে একটি রূপা ও দুটি ব্রোঞ্জ পেয়েছিল বাংলাদেশ। তিনটি পদকই ছিল দলগত ইভেন্ট থেকে পাওয়া। রিকার্ভ মিশ্র থেকে এসেছিল রূপার পদক। ২০২৩ সালের সবশেষ থাইল্যান্ডের আসরে অবশ্য খালি হাতে ফিরতে হয় দলকে। এবার সে হতাশার বলয় থেকে বাংলাদেশকে বের করে আনতে চান আরচ্যাররা।
রিকার্ভ ইভেন্টের সাগর ইসলাম (র্যাঙ্কিংয়ে ৭৫তম) বলেন, “আমাদের দেশের মাঠে এবারের প্রতিযোগিতা। স্বাভাবিকভাবে অনেক কিছু আমাদের পক্ষে থাকবে। এখানকার সবকিছুই আমাদের জানা। এই প্রতিযোগিতার জন্য আমরা বছর জুড়ে ক্যাম্পে কঠোর পরিশ্রম করেছি। আশা করি, পরিশ্রমের ফল আমরা পাব। দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারব।”
রিকার্ভ ইভেন্টের আরেক আরচ্যার আব্দুর রহমান আলিফ (র্যাঙ্কিংয়ে ৭১তম) বলেন, “বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক ভালো মানের আরচ্যার এসেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত থেকে এসেছে অনেকে। অভিজ্ঞতায় তারা হয়ত এগিয়ে থাকবে, তবে আমাদেরও আত্মবিশ্বাস আছে দেশকে ভালো কিছু এনে দেওয়ার। আরচ্যারী একটি নির্দিষ্ট দিনের খেলা, র্যাঙ্কিংয়ে অবস্থান যা-ই হোক না কেন, যে সেরাটা মেলে ধরতে পারবে, সেই সেরা হবে।”
কম্পাউন্ড ইভেন্টের আর্চার বন্যার আক্তার (৮৫তম) বলেন, “কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখের অধীনে আমরা এতদিন অনুশীলনে যে পরিশ্রম করেছি, আমাদের জন্য সে পরিশ্রমের ফল তুলে আনার উপলক্ষ্য এই আসর। সামর্থ্যরে সবটুকু দিয়ে আমরা চেষ্টা করব।”
কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখ বলেন, “আরচ্যারদের প্রতি আমার আস্থা আছে। ব্যাংককের গত আসরে আমরা কোনো পদক পাইনি। এ নিয়ে হতাশা আছে ওদের মধ্যে। এবার ভালো ফল করতে ওরা উন্মুখ হয়ে আছে।”
আরচ্যারী ফেডারেশন অবশ্য খেলোয়াড়দের উপর প্রত্যাশার চাপ দিতে রাজি নয়। ফেডারেশনের সদস্য ও লোকাল অর্গানাইজিং কমিটির চেয়ারম্যান কাজী রাজীব উদ্দীন আহমেদ চপল যেমন বলেন, “এবারের আসরে আমাদের সাফল্যের ধারা যেন থাকে, এজন্য আপনারা দোয়া করবেন। এর আগে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে আমরা অনেক পদক পেয়েছি। সোনা ৪৩টির বেশি, রূপা ও ব্রোঞ্জ ৫০টির বেশি আছে আমাদের অর্জনের শোকেসে। আমরা অবশ্যই চাইব এবার বাংলাদেশ সাফল্য পাক। যদি সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারি, তাহলে আমরা আশা করি ফাইনালেও ভালো করব।”
উদ্বোধনী দিনে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে হবে আরচ্যারীর কংগ্রেস ও নির্বাচন। পরবর্তী চার বছরের জন্য এশিয়ান আরচ্যারীর সভাপতি নির্বাচিত করবেন ৩৮ জন ভোটার। কংগ্রেস বেলা ৩টায় শুরু হয়ে শেষ হবে সন্ধ্যা ৬ টায়। ভোট গ্রহণ চলবে ৩ টা ১৫ মিনিট থেকে ৪ টা পর্যন্ত। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ভোট হবে।
সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বাংলাদেশ আরচ্যারী ফেডারেশনের সদস্য কাজী রাজীব উদ্দীন আহমেদ চপল ও বর্তমান সভাপতি চুং ইউসান। ২০০৫ সাল থেকে এ নিয়ে টানা পাঁচ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন চুং ইউসান। দক্ষিণ কোরিয়ার এই ধনকুবের হুন্দাই মোটর গ্রুপের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান ও সিইও।
বাংলাদেশের আরচ্যারীর প্রতিষ্ঠাতা চপল সংগঠক হিসেবে অভিজ্ঞ। বর্তমানে ওয়ার্ল্ড আরচ্যারীর ইলেকটোরাল বোর্ডের সদস্য, ওয়ার্ল্ড আরচ্যারী এশিয়ার সহ-সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। এশিয়ান আরচ্যারীর এবারের আসরের লোকাল অর্গানাইজিং কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ‘পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর জন্য কোরিয়ার মানের সুবিধা নিশ্চিত করা, অঞ্চল ধরে ধরে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া, আঞ্চলিক ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের অকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন তিনি।
সবকিছুকে ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত সব আকর্ষণের কেন্দ্রে অবশ্য থাকবেন আরচ্যাররাই। বাংলাদেশের আলিফ, সাগর, ভারতের ধীরাজ বোম্মাডেভারা, অতনু দাস, দীপিকা কুমারী, দক্ষিণ কোরিয়ার সিও মিনগি, কিম ইয়াচেন, কিংবা ইরাকের ফাতিমা আলমাশদানি নাকি নতুন অচেনা কেউ বাজিমাত করবেন, সেদিকে চোখ থাকবে এশিয়ার আরচ্যারীপ্রেমীদের।