ঢাকা, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস): ‘তৈরি পোশাকশিল্পে (গার্মেন্টে) কর্মরত নারী শ্রমিকদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার’ নিয়ে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ-আইসিডিডিআর,বি আজ একটি গবেষণা উপস্থাপন করেছে।
ঢাকার মহাখালী ক্যাম্পাসের সাসাকাওয়া মিলনায়তনে আয়োজিত সেমিনারে গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার সহায়তায় অ্যাডসার্চ বাই আইসিডিডিআর,বি পরিচালিত ২৪ মাসব্যাপী কোহর্ট গবেষণার এই ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। উল্লেখ্য, এটি বাংলাদেশে পরিচালিত প্রথম এ ধরনের কোনো গবেষণা।
গবেষণাটি ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কড়াইল ও মিরপুর বস্তি এবং গাজীপুরের টঙ্গী বস্তিতে, আইসিডিডিআর,বি’র আরবান হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সার্ভেইলেন্সের আওতাধীন এলাকায় পরিচালিত হয়। এখানে ১৫ থেকে ২৭ বছর বয়সী মোট ৭৭৮ জন তৈরি পোশাক শ্রমিককে নিয়ে প্রতি ছয় মাস অন্তর জরিপের মাধ্যমে গবেষণা চালানো হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, পোশাকশিল্পে কর্মরত নারীদের মধ্যে প্রতি তিনজনের দুইজনের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। এদের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ নারী ১৮ বছর হওয়ার আগেই প্রথম গর্ভধারণ করেছেন। প্রায় প্রতি তিনজনের একজন নারী শ্রমিক অন্তত একবার অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার হয়েছেন এবং প্রতি চারজনের একজন নারী গর্ভপাত বা মেনস্ট্রুয়াল রেগুলেশনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
গবেষণার শুরুতে দীর্ঘমেয়াদি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা ছিল ৪৯ শতাংশ নারীর মধ্যে, যা দুই বছর শেষে বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ শতাংশে। জরুরি গর্ভনিরোধক বড়ি/ট্যাবলেট সম্পর্কে জ্ঞান শুরুতে ছিল ১৫ শতাংশ নারীর মধ্যে, যা পরে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ শতাংশে। পরিবার পরিকল্পনায় স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মতামতের প্রাধান্য দেওয়ার ইতিবাচক মনোভাব ৫৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ শতাংশে।
নারী শ্রমিকরা ঘর ও কর্মস্থল উভয় জায়গায় সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। গত ১২ মাসে স্বামীর সহিংসতার হার ছিল অনেক বেশি। যৌন সহিংসতা ছাড়া অন্যান্য সহিংসতাও গত দুই বছরে বেড়েছে। কর্মক্ষেত্রে মানসিক সহিংসতার হারও বেশি ছিল। গবেষণার শুরুতে প্রায় ৪৮ শতাংশ নারী গার্মেন্ট শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে মানসিক সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন, যা দুই বছর পর এখন বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫ শতাংশ।
উদ্বেগজনক বিষয় হলো, সহিংসতার শিকার নারীরা আনুষ্ঠানিক সাহায্য প্রায় কেউই চাইতে যান না। শুরুতে ৩৫ শতাংশ নারী অনানুষ্ঠানিক (পরিবার বা বন্ধুদের কাছে) সাহায্য চেয়েছিলেন, কিন্তু দুই বছর শেষে তা নেমে দাঁড়ায় মাত্র ২১ শতাংশে। কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার ঘটনায়ও প্রতি পাঁচজনের মধ্যে মাত্র একজন নারী কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, এবং এই হার অপরিবর্তিত রয়েছে।
যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু পরামর্শমূলক সেবা থাকলেও প্রয়োজনীয় সরবরাহ সীমিত। জরিপে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের কারখানার মধ্যে মাত্র ২২ শতাংশ কারখানায় স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায় এবং মাত্র ১৪ শতাংশ কারখানায় পরিবার পরিকল্পনার সামগ্রী সরবরাহ করা হয়।
গবেষণায় কিশোরী গর্ভধারণের মূল নিয়ামকগুলোর দিকেও আলোকপাত করা হয়। প্রথম গর্ভধারণের আগেই গর্ভনিরোধক ব্যবহারকারীদের কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি ৪৭ শতাংশ কম। প্রথম গর্ভধারণের আগেই পোশাকশিল্পে কাজ শুরু করা নারীদের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি কম পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, স্বামীর সহিংসতার অভিজ্ঞতা থাকলে কিশোরীবয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি ২৬ শতাংশ বেড়ে যায়।
নারীর ক্ষমতায়নের বিভিন্ন দিক স্বামীর সহিংসতাকে ভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকলে মানসিক ও যৌন সহিংসতা থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। মতামত প্রকাশের ক্ষমতা থাকলে যৌন সহিংসতা কমে। চলাচলে স্বাধীনতা বেশি হলে শারীরিক সহিংসতার ঝুঁকি কম হয়।
সেমিনারে আলোচক ছিলেন- পপুলেশন কাউন্সিল বাংলাদেশ’র সাবেক পরিচালক ড. উবাইদুর রব, বিকেএমইএ’র যুগ্ম সম্পাদক ফারজানা শারমিন এবং মেরী স্টোপস বাংলাদেশ’র সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াসমিন এইচ আহমেদ। গবেষণাটির প্রধান গবেষক ছিলেন- আইসিডিডিআর,বি’র এমিরেটাস সায়েন্টিস্ট ড. রুচিরা তাবাসসুম নবেদ।
ড. রুচিরা তাবাসসুম নবেদ বলেন, ‘অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত নারীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অন্য নারীদের চেয়েও খারাপ। এই পরিস্থিতি উন্নয়নে বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন। এজন্য সরকার, উন্নয়ন সংস্থা ও অংশীদারদের সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।’
ফারজানা শারমিন বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের জন্য ‘ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স’ রাখা কঠিন। গর্ভধারণের মতো বিষয়েও তাদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সচেতনতা সৃষ্টি ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সহজলভ্য করা জরুরি। পাশাপাশি সরকারি ক্লিনিকের সময়সূচি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
ইয়াসমিন এইচ আহমেদ বলেন, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীরা ওষুধের দোকান থেকেও স্বল্পমেয়াদি জন্মবিরতিকরণ সামগ্রী নিতে পারেন না। তাই গার্মেন্টে কাউন্সেলিং-এর পাশাপাশি এসব সামগ্রী নিশ্চিত করা দরকার।
ড. উবাইদুর রব বলেন, নারীদের কর্মক্ষেত্র এখন শুধু গার্মেন্টেই সীমাবদ্ধ নেই। তবে যেখানে কাজ করুক না কেন, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ কমাতে জ্ঞান বৃদ্ধি অত্যাবশ্যক।